প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ঔষধ, প্রযুক্তি Class XI History Project
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ঔষধ, প্রযুক্তি
Class XI History Project
ভূমিকা
ভারতীয় সভ্যতা বহু প্রাচীন। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এখানে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও উন্নতি হয়েছিল। শিক্ষা ও সংস্কৃতির এই সুমহান ঐতিহ্যে বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও প্রযুক্তির বিশেষ অবদান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালকে ভারতীয় বিজ্ঞান ইতিহাসের সুবর্ণযুগ বলা যেতে পারে।
বিজ্ঞান
ঐতিহাসিক গবেষণা প্রমাণ করে যে, খ্রিস্টপূর্ব তিনহাজার বছর আগেও ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। সিন্ধুনদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োর নগর পরিকল্পনা, কৃষিব্যবস্থা, হস্তশিল্প, তত্ত্বশিল্প তারই সাক্ষ্য বহন করে। গুপ্তযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভারতীয় মনীষ্যর অদ্ভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। আর্যভট্ট ও বরাহমিহির ছিলেন এই যুগের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক। চিকিৎসাশাস্ত্রেও এইযুগে যথেষ্ট প্রসার ঘটে। সম্ভবত শল্য-চিকিৎসাও এই যুগে প্রচলিত ছিল এবং অনেকের মতে শল্যবিদ্যায় পারদর্শী সুশ্ৰুত গুপ্তযুগেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সৃষ্টি, স্রষ্টা ও বিশ্বব্রান্ডের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কী, সে বিষয়ে দার্শনিক চিন্তাধারার প্রবক্তা হিসেবে কণাদের নাম উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ছ'শো বছর পূর্বে তিনি তাঁর “বৈশেষিকসূত্র” গ্রন্থে যে সুচিন্তিত আলোচনা তথ্য সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন তা বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। এই সূত্রগুলি থেকে পরমাণু সম্পর্কে এক স্বচ্ছ ধারণা আমরা পেয়ে থাকি। বস্তুত অস্তিত্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অবিভাজ্য, চিরস্থায়ী অংশটিকে তিনি পরমাণু নাম দিয়েছিলেন। কণাদের মতে, এই বিশ্বরমান্ডের যাবতীয় বস্তুর অস্তিত্ব ও গঠন নির্ভর করে বিভিন্ন পরমাণুর বিভিন্ন পদ্ধতিতে মিলন এবং পরমাণুর ওপর উত্তাপের প্রতিক্রিয়া কী, সেই ফলাফলের ওপর।
গণিত চৰ্চা
অতি প্রাচীন কাল থেকে ভারতে বিজ্ঞান চর্চার প্রচলন শুরু হয়। শুদ্ধসূত্রে গণিতের পদ্ধতিগত দিকগুলি নির্দেশিত হয়েছে। প্রাচীন কালে যাগযজ্ঞ চর্চার সূত্র ধরে গণিত বিশেষত জ্যামিতি চর্চার ভিত্তি রচিত হয়। সংখ্যা ও গণনের চর্চাও বৈদিক যুগে শুরু হয়। ঋগ্বেদে শত সহস্র, অযুত প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রাচীন কালে ভারতীয় গণিতবিদরা গণিত শাস্ত্রে প্রথম দশাঙ্ক সংখ্যার প্রচলন করেন। মহাভারত ও পুরাণে দশাক সংখ্যার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। ব্রহ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, মৎস্য পুরাণ প্রভৃতিতে দশাঙ্ক সংখ্যার খোঁজ পাওয়া যায়। এছাড়া শূন্যের ব্যবহার ও সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা ভারতীয় সাহিত্যে দেখা যায়। শূন্যের সাহায্যে যোগ ও বিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন ব্রহ্মগুপ্ত। গণিত বিষয়ে চর্চার প্রচলন অনেক আগে শুরু হলেও আর্যভট্টের পূর্বে কোনো প্রামাণ্য গঠিত গ্রন্থ রচিত হয় নি (৪৭৬ খ্রিঃ)।
ঔষধ
প্রাচীন ভারতে ঔষধ বলতে বোঝায় মূলতঃ আয়ুর্বেদ চর্চা ও তার প্রয়োগকে। ভারতীয়গণ বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির ভিত্তিতেই এই শাস্ত্র চর্চা করত। ঔষধ বা আয়ুর্বেদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দুই ব্যক্তি ছিলেন। | সুশ্ৰুত ও চরক।
সুশ্ৰুত
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে সুশ্রুত জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অধুনা বেনারসে দিবদাস ধন্বন্তরীর কাছে শল্যচিকিৎসা ও ঔষধ প্রদান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের উভয় শাখায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সমগ্র পৃথিবীতে তিনি 'প্লাস্টিক সার্জারী'র পথিকৃৎ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর রচিত ‘সুশ্রুত সংহিতা' বর্তমান কালের চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। শল্যচিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তিনি বিবিধ নামকরণ করেছিলেন, যেমন–—–শলাকা যন্ত্র, তাল যন্ত্র, নাড়ী যন্ত্র ইত্যাদি। প্রাণীজগতকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা, ভ্রূণের উৎপত্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়েও তাঁর বিশ্লেষণধর্মী রচনা দেখা যায়।
চরক
চরক খ্রিস্টপূর্ব দুশো বছর আগে তাঁর 'চরক সংহিতা'য় শারীরবিদ্যা, ধাত্রীবিদ্যা ও প্রজননবিদ্যার ক্ষেত্রে নানাবিধ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন এবং তা বর্তমানকালেও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই ছিলেন প্রথম মনুষ্যদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, পরিপাক ইত্যাদি বিষয়ে সুচিন্তিত ধারণার প্রবক্তা। ডিম্বাণুর ওপর পুষ্টিজনিত খাদ্যের প্রতিক্রিয়া নিয়েও তিনি আলোকপাত করেন। বংশগতির ওপর বৈজ্ঞানিক তথা গবেষণামূলক আলোচনাও চরকের রচনায় পাওয়া যায়।
পতঞ্জলি
যোগ বা ধ্যানের মাধ্যমে মানুষ যে নীরোগ, দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারে, সে সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় উপনিষদ্ ও অথর্ববেদের আলোচনায়। কিন্তু যোগসাধনার কৌশলগত প্রয়োগভিত্তিক মৌলিক আলোচনার প্রবক্তা হিসেবে পতগুলির নাম উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে পতগুলি সৃষ্টি এবং তার ক্রমবিকাশ নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। পতঞ্জলির মতে, মানুষের দেহে বিভিন্ন নালিকাপথ এবং কেন্দ্র রয়েছে, যাদের তিনি যথাক্রমে নাড়ী ও চক্র আখ্যা দিয়েছেন। নাড়ী ও চক্রকে আয়ত্তাধীন করতে পারলে দেহের অন্তর্নিহিত শক্তিকেন্দ্র কুন্ডলিনীর সন্ধান পাওয়া যায়, যা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি লাভে সহায়তা করতে পারে।
জ্যোতির্বিদ্যা
খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ শতক পরে, আর্যভট্টের সময়কালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যাশাস্ত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। আর্যভট্ট প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং তা নিজের অক্ষের ওপর প্রতিনিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। এই আবর্তনের কারণেই পৃথিবীতে দিন ও রাত হয়। চন্দ্র যে সূর্যের আলোয় আলোকিত এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ পুরাণ কথিত রাহুগ্রাসের ফল নয়, স্বাভাবিক জ্যোতির্বিদ্যাসম্মত ঘটনা ফল, সে কথাও তিনি প্রথম ঘোষণা করেন। আর্যভট্ট রচিত 'সূর্য-সিদ্ধান্ত' নামক গ্রন্থে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের কারণের মনোরম বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি গ্রহ-উপগ্রহগুলির অবস্থিতি সম্পর্কেও মনোজ্ঞ বিবরণ রেখে গেছেন। বরাহমিহির রচিত 'বৃহৎ-সংহিতা' ও 'পৎসিদ্ধান্ত' নামক গ্রন্থে গ্রিক ও রোমান জ্যোতিষশাস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং এইরূপ অনুমান করা যেতে পারে যে, ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা রোমান ও গ্রিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।
প্রযুক্তি
প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতা ও অন্যান্য সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া গেছে সেখানে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, সীসা, টিন, লৌহ, ব্রোধ প্রভৃতি ধাতুর নির্মিত তৈজসপত্র বা স্তম্ভ থেকে বলা যায় যে, ভারতীয়গণ খনি হতে এই সমস্ত ধাতুর উত্তোলন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। ধাতুশিল্পের উন্নতিপ্রসঙ্গে মেহরৌলি স্তম্ভের কথা বলা যায়। কৃষিকাজ ও গৃহস্থালী কাজের উপযোগী যন্ত্রপাতি নির্মাণ এবং যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিভিন্নধর্মী প্রযুক্তি। তাছাড়া যেসমস্ত যন্ত্রপাতির সাহায্যে সুউচ্চ মন্দির নির্মিত হয়েছিল তা প্রযুক্তিহীন ছিল না। শরীরের নানা স্থানে ও মস্তিষ্কে অস্ত্রোপ্রচার বা শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়েছিল।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ঔষধ প্রভৃতি ক্ষেত্র ছিল যথেষ্ট উন্নত। এই উন্নতির পশ্চাতে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা, ভারতীয় মণীষা এবং ভারতীয় অনুসন্ধিৎসা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
গ্রন্থপঞ্জি
- অতুলচন্দ্র রায় ও সুরঞ্জনা সান্যাল = ভারতের ইতিহাস
- অধ্যাপক চক্রবর্তী ও চক্রবর্তী =সরল ভারতের ইতিহাস (Part-1)
- সমরেন্দ্র নাথ সেন = বিজ্ঞানের ইতিহাস
- R. C. Majumdar (ed) = The Classical Age
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এই প্রকল্পটি তৈরি করতে আমার বিদ্যালয়ের ইতিহাস শিক্ষক-শিক্ষিকা মূল্যবান পরামর্শদান ও সহযোগিতা করেছেন। প্রত্যেককেই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে।
আমি হৃদয় মণ্ডল
আমার বাড়ি= তালবারি
পোস্ট= শকুন্তলা
থানা= চাকুলিয়া
আমি এই বার একাদশ শ্রেণী তে পড়ি রায়গঞ্জ মোহনবাতি হাই স্কুল উচ্চ বিদ্যালয়
Nice👍👍