ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গোষ্ঠী Class XI History Project

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গোষ্ঠী 

Class XI History Project




ভূমিকা


প্রাচীন ভারতে পরবর্তী বৈদিকযুগে উপনিষদের সময়কাল থেকেই দর্শনচিন্তার বিকাশ শুরু হয়েছিল এবং খ্রিঃপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দার্শনিক চিন্তাভাবনার সংহতি সাধিত হয়েছিল। ভারতীয় দর্শনের দুটি দিক লক্ষণীয় যথা সনাতন দর্শন, যার অন্তর্গত ছিল ষড়দর্শন বা ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্ব মীমাংসা ও বেদান্ত। এছাড়া ছিল সনাতন দর্শন বিরোধী জৈন, বৌদ্ধ ও চার্বাক দর্শন।


ন্যায় দর্শন


ন্যায়—গোষ্ঠীর দার্শনিক চিন্তাভাবনার ভিত্তিভূমি হলো অক্ষপাদ গৌতম রচিত 'ন্যায়সূত্র' নামক গ্রন্থ, যা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রচিত হয়েছিল। এছাড়া ন্যায়সূত্রের ওপর বাৎসায়নের লেখা ভাষ্য ও ষষ্ঠ শতকের ‘ন্যায়-বর্তিকা' ছিল উল্লেখযোগ্য দর্শন গ্রন্থ। এই দর্শনের মূল কথা হলো মোক্ষলাভ এবং আত্মার বন্ধনমুক্তি। আত্মার সঙ্গে দেহ ও ইন্দ্রিয়সমূহের বন্ধন হলো আত্মার বদ্ধাবস্থা এবং এর বিপরীত অবস্থা হলো মুক্তাবস্থা। ন্যায় দর্শন বেদের ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। ন্যায় দর্শনের অনুগামীগণ যথার্থ জ্ঞান অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, যার মাধ্যমে দুঃখকে জয় করা সম্ভব বলে মনে করা হত। মূলত জ্ঞানার্জনের উৎস হলো চারটি—প্রত্যক্ষকরণ, সিদ্ধান্ত, তুলনা ও সাক্ষ্যপ্রমাণ (testimony)। ন্যায় দর্শনে ১৬টি পদার্থ বা উপাদানের কথা বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, তর্ক, মীমাংসা, আলোচনা, জল্প প্রভৃতি। এছাড়া এই দর্শনে কার্যকারণ সম্পর্কের কথাও গুরুত্ব পেয়েছে। জগৎ একটি কার্যপদার্থ এবং জগতের একটি কারণ রয়েছে। এই কারণই হলো ঈশ্বর।


বৈশেষিক দর্শন


ভারতের ষড়দর্শনের অন্যতম দর্শন ছিল বৈশেষিক দর্শন, যা ন্যায় দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে কণাদ তাঁর রচিত বৈশেষিক সূত্র' গ্রন্থে এই দর্শনের সবিশেষ ব্যাখ্যা করেন, তাই এই দর্শন কণাদ-দর্শন নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে ‘বৈশেষিক সূত্র' গ্রন্থের দুটি ভাষ্য ‘রাবণভাষ্য’ ও ‘ভরদ্বাজভট্ট’ রচিত হয় এবং চতুর্থ শতাব্দীতে প্রশস্তপাদ রচিত ‘পদার্থধর্ম সমগ্র' ছিল অপর বিখ্যাত গ্রন্থ। সপ্তম শতকে রচিত হয়েছিল অপর একটি গ্রন্থ ‘দশ পদার্থশাস্ত্র"। বৈশেষিক দর্শন আত্মাকে নিত্য, বিভু ও বাহু বলে স্বীকার করা হয়েছে। আত্মার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা শক্তি না থাকলেও মনের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে এবং আত্মাতে ইচ্ছা, দ্বেষ, গুণ অনুভূত হয়। পদার্থের সাক্ষাৎ জ্ঞানে আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়সমূহের সংযোগ ছিন্ন হয় এবং আত্মার বন্ধন দশার অবসান ঘটে।


সাংখ্য দর্শন


কপিল মুনি ছিলেন সাংখ্য দর্শনের আদি প্রবক্তা। এই দর্শনের প্রধান গ্রন্থ 'সাংখ্য কারিকা' আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রচিত হয়েছিল এবং এই গ্রন্থে সাংখ্য দর্শনকে তন্ত্র ও তন্ত্রসাধনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল, এই দর্শনের দুটি দিক ছিল যথা পুরুষ বা আত্মা এবং প্রকৃতি। পুরুষ বা আত্মা হলো দেহাতিরিক্ত এক চৈতন্যসত্তা, যা নিষ্ক্রিয় ও নির্গুণ। আত্মা সুখ, দুঃখ, মোহবিহীন এবং একই সঙ্গে আনন্দবিহীন। আত্মা প্রকৃতির সংযোগে এলে প্রকৃতিনির্ভর হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতির সুখ, দুঃখ প্রভৃতি গুণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। এভাবে আত্মা প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে নিজের স্বরূপ বিস্তৃত হয়ে প্রকৃতির গুণে আবদ্ধ হয়। প্রকৃতির তিনটি দুঃখ যথা—আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক ও আদিদৈবিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আত্মা দুঃখজর্জরিত হয়। একমাত্র বিবেকজ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান লাভের মাধ্যমেই জীব-আত্মা ও প্রকৃতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে এবং এর পরিণামে প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার বিচ্ছেদ ঘটে ও আত্মা স্ব-রূপে প্রত্যাবর্তন করে। ফলত জীবের মুক্তি ঘটে।


যোগ দর্শন


যোগ দর্শন পাতঞ্জল দর্শন নামেও পরিচিত। এই দর্শন সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতি ও আত্মা তত্ত্বকে মেনে নিয়েছিল। তবে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মাকে স্বাভাবিক শুদ্ধ ও মুক্ত সভায় ফিরিয়ে আনতে যোগসাধনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল যোগ দর্শন। এই দর্শন ঈশ্বরবিশ্বাসী। তাই যোগসাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ ও মোক্ষলাভ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। যোগসাধনার জন্য আটটি পর্যায় বা ধাপ ছিল যথা—সংযত আচরণ (যম), নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার নিয়ন্ত্রণ ধারণা, ধ্যান, সমাধি। অষ্টম পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হলে আত্মা প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয় বলেই যোগ দর্শনের বিশ্বাস।


পূর্ব মীমাংসা


খ্রিঃ পূর্ব প্রথম শতকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে বৈদিক ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদ ও যজ্ঞানুষ্ঠান প্রায় মুছে যেতে শুরু করেছিল তখন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি বা দার্শনিক বৈদিক গ্রন্থের জটিল জটিল ব্যাখ্যার মাধ্যমে। বৈদিক রীতিনীতির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। গুপ্তযুগে সাবরা রচিত 'মীমাংসাসূত্র ভাষ্যম' এবং সপ্তম অষ্টম শতকে কুমারিল ভট্ট ও প্রভাকরের রচনা এই গোষ্ঠীর মতামতকে দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে খ্রিঃ পূর্ব তৃতীয় শতকে জৈমিনির 'পূর্ব মীমাংসাসূত্র' ছিল এই দর্শনের আকরগ্রন্থ। বেদের ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই এই দর্শনে উচ্চারিত হয়েছিল যে, আত্মা, দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন। আত্মা নিত্য হলেও কর্মফল ভোগের জন্য দেহ ধারণ করে। স্বর্গলাভই হলো জীবের পুরাষার্থ, যা বেদ নির্দেশিত যজ্ঞকর্মের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভব। যজ্ঞানুষ্ঠান আত্মায় এক শক্তি (অপূর্ব) সঞ্চার করে। তাছাড়া এই দর্শনের মতে বেদ নির্দেশিত কর্ম সম্পাদনে পুণ্য এবং নিষিদ্ধ কর্মে পাপের উদ্ভব হয়। পাপের ফলে আত্মাকে নরকবাস করতে হয়।


উত্তর মীমাংসা


বৈদিক সাহিত্যে উপনিষদকে ‘বেদান্ত' বলে অভিহিত করা হত কিন্তু আদি-মধ্যযুগ বেদান্ত বলতে উত্তর-মীমাংসা দর্শনকে বোঝানো হতে থাকে। | আনুমানিক খ্রিঃ পূর্ব ২০০ অব্দ নাগাদ এই দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে এবং এই দর্শন উত্তর-ব্রহ্মসূত্র, শরীরক, বেদান্ত দর্শন নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী কালে বেদান্ত দর্শনে মূলত দুটি ভাগ ছিল অদ্বৈত ও দ্বৈত। এই দর্শনের মূল কথা হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের নিমিত্ত ও উপাদান হলো ব্রহ্ম বা পরমাত্মা। তিনি সর্বভূতে বিরাজমান। ব্রষ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমেই জীব দুঃখ থেকে নিবৃত্তি লাভ করে। আদি শঙ্করাচার্য ও তাঁর গুরু গৌড়পাদ অদ্বৈত বেদান্তের প্রচার করেন এবং নিম্বার্ক প্রচার করেন দ্বৈতবেদান্ত দর্শন।


জৈন দর্শন


খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে বিশেষত বিহারে বৈদিক আধিপত্যের প্রতিক্রিয়া রূপে জৈন দর্শনের উদ্ভব ঘটেছিল। বৈদিকযুগে জৈনধর্মে দু'ধরনের দার্শনিক চিন্তা লক্ষণীয় যথা——–শ্রমণ ও আজীবক। জৈনধর্মের দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো মোক্ষ বা মুক্তি লাভ। জৈন দর্শন অনুসারে জ্ঞান ও ক্রিয়ার মাধ্যমে এই মুক্তি অর্জন করা যায়। তাই জ্ঞান, কর্ম (ক্রিয়া) ও মুক্তি—এই তিনটি গুণকে জৈনরা ত্রিরত্ন বলে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা ঈশ্বর কর্তৃক বিশ্বের সৃষ্টি তারা বিশ্বাস করে না, তাদের মতে শুদ্ধ এবং পূর্ণ বিকশিত মানবাত্মাই হলো দেবতা। জৈনদের বিশ্বাস জড় ও অজড় বস্তুমাত্রেরই কম বেশি সচেতন আত্মা আছে।


বৌদ্ধ দর্শন


বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ সনাতনী হিন্দু দর্শনের কিছু অংশ বাতিল করেছিলেন। বৌদ্ধ দর্শন মূলত বৈদিক দর্শন ও মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই বিকশিত হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনের কর্মবাদ’ ও ‘আত্মার দেহান্তরবাদ প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্ম থেকে গৃহীত। বৌদ্ধধর্মের 'অহিংসার' আভাষ উপনিষদে পাওয়া যায়। তবে বৌদ্ধ দর্শন ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব এবং বেদের অপৌরুষেয়তায় বিশ্বাস করে না, যাগ-যজ্ঞাদি ক্রিয়াকান্ড মোক্ষের | সোপান বলেও মনে করে না।


চার্বাক দর্শন


চার্বাক দর্শন লোকায়ত দর্শন নামেও পরিচিত এবং এই দর্শন ছিল বস্তুবাদী দর্শন যা মৌর্যযুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার কারো মতে বৃহস্পতি ছিলেন এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। এই দর্শন 'প্রত্যঙ্ক' নীতিতে বিশ্বাসী ছিল অর্থাৎ যা দেখা যায় না তার অস্তিত্বও এই দর্শন স্বীকার করেনি। তাই এই দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। অনুরূপভাবে জন্মান্তর বা কর্মফলবাদ তত্ত্ব এই দর্শনে স্বীকৃত হয়নি। আত্মা দেহের বাইরের কোনো বস্তু নয়, তা দেহেরই অংশ, দেহ বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই আত্মারও বিনষ্টি ঘটে। তাই এঁরা মানুষের জীবনকালের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছিল এবং এই জীবনে জাগতিক সুখভোগ করাকেই তাঁর লক্ষ্যে পরিণত করেছিল।


উপসংহার


উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর দর্শনচিন্তায় পার্থক্যের পাশাপাশি কয়েকটি দর্শনের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব, আত্মার বন্ধন ও মুক্তি, পরজন্ম ও বাস্তবতাবাদ এগুলিকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় দর্শন বিবর্তিত হয়েছিল।


গ্রন্থপঞ্জি

  1. S. N. Dasgupta- A History of Indian Philosophy (Vol I-V)
  2. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়—ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে।
  3. অতুলচন্দ্র রায় ও সুরঞ্জনা সান্যাল—ভারতের ইতিহাস
  4. অধ্যাপক চক্রবর্তী ও চক্রবর্তী—সরল ভারতের ইতিহাস (Part-I)


কৃতজ্ঞতা স্বীকার


এই প্রকল্পটি তৈরি করতে আমার বিদ্যালয়ের ইতিহাস শিক্ষক-শিক্ষিকা মূল্যবান পরামর্শদান ও সহযোগিতা করেছেন। প্রত্যেককেই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে।





-----------------------------------

পিডিএফ লিঙ্ক

----------------------------------

1 Comments
  • Unknown
    Unknown March 9, 2022 at 11:42 AM

    Op

Add Comment
comment url