ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর, Class 11 2nd Semester
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর : মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির রচিত ভাব সম্মিলনের একটি পদ একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিস্টারের পাঠ্য।
এই পাঠ্য থেকে উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন এখানে সংযোজিত হলো। সিলেবাস অনুযায়ী 2 ও 3 নম্বরের প্রশ্ন আসবে এখান থেকে। তবে পর্ষদ প্রকাশিত প্রশ্ন অনুসারে প্রশ্নগুলি (২+৩ = ৫) এই প্যাটার্নে পরীক্ষায় আসবে বলে মনে হয়। সেজন্য এখানে সেইভাবেই প্রশ্নগুলি নির্বাচিত হয়েছে।
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর, Class 11 2nd Semester
১. ভাব সম্মিলন কাকে বলে? আলোচ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিতে রাধার যে আনন্দের চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় লেখো। ২+৩
(উত্তর) ভাব সম্মিলন : বৈষ্ণব পদকর্তাগণ শ্রীমতী রাধার বিরহ-বিকারের আবেশ-জাত কল্পনার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গ-সুখ উপভোগের যে পর্যায় নির্ধারণ করেছেন তাকে ‘ভাবসম্মেলন’ নামে অভিহিত করা হয়।
বৈষ্ণব রসশাস্ত্র অনুযায়ী প্রবাসের পর যখন নায়ক-নায়িকার মিলন সাধিত হয় তাকেই বলা হয় ‘সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ’। কিন্তু বাস্তবে নায়ক শ্রীকৃষ্ণ মথুরা প্রবাসের পর আর কখনো বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি বলেই শ্রীরাধার সঙ্গে তাঁর মিলন সম্ভব নয়। তবে বাস্তব জগতে যা সম্ভবপর নয়, ভাবজগতে তা সম্ভব। তাই বৈষ্ণবকবিগণ ভাবজগতে রাধাকৃষ্ণের মিলন সাধনের ব্যবস্থা করেছেন। অর্থাৎ ভাবজগতে স্বপ্ন-কল্পনার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমতী রাধার যে ‘স্বপ্ন-সম্ভোগ’ তাকেই ‘ভাবসম্মেলন’ বা ‘ভাবোল্লাস’ বলে অভিহিত করা হয়।
রাধার অন্তরের আনন্দের চিত্র
সুদীর্ঘ বিরহ-যন্ত্রণা ভোগ করার পর মিলনের আনন্দে শ্রীরাধিকার অন্তরে যে উল্লসিত ভাব জেগেছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘মৈথিল কোকিল’ বিদ্যাপতি রচিত পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিতে। এই ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় বিদ্যাপতির রাধা সাধারণ মানুষের মতোই সুখে উল্লসিত হন।
বহু বিরহের কাল কাটিয়ে আজ তিনি মিলনের আনন্দে উত্তাল। শ্রীকৃষ্ণ দর্শনে নিমেষে বিরহের দুঃখ ছাপিয়ে মিলনের আনন্দ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রাধিকার মনে হচ্ছে কৃষ্ণ যেন চিরকাল তাঁর পাশে তাঁর ঘরেই আছেন। পাপী চাঁদ এতদিন তাঁকে যত দুঃখ দিয়েছে, প্রিয় মুখ দর্শনে আজ ঠিক ততখানিই সুখ তিনি পেয়েছেন। এখন যদি কেউ আঁচল ভরে ধন-ঐশ্বর্য দেয় তবু তিনি আর কৃষ্ণকে ছাড়তে পারবেন না। জগতের কোনো ধন ঐশ্বর্যই তো কৃষ্ণের সমতুল নয়। কারণ কৃষ্ণ তো রাধার শুধুমাত্র প্রেমিক বা বন্ধু নন, তিনিই তো রাধিকার সর্বস্ব। তিনি তাঁর শীতের চাদর, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, অকূল দরিয়ার নৌকো। তিনিই তাঁর ইহকাল, পরকাল। তিনিই তাঁর জগৎ, তিনিই তাঁর জগদীশ্বর।
শ্রীরাধিকার এতদিনের বিক্ষত যন্ত্রণাকে সম্পূর্ণ ভুলে মিলনের আনন্দে অধীর। তাই আজ তাঁর আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা নেই—
“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।”
বিদ্যাপতির এই পদে রাধার অন্তরে যে উচ্ছ্বসিত আনন্দ জেগে উঠেছে তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অনুপম ভঙ্গিতে। শ্রীমতী রাধিকা কৃষ্ণ-মিলন জনিত অপার্থিব সুখের উল্লাসে তৃপ্ত হয়েছেন, পরম আনন্দে উন্মুখর হয়েছেন।
২. গীতিকবিতার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটিকে সার্থক গীতিকবিতা বলা যায় কিনা তা সংক্ষেপে লেখো। ২+৩
(উত্তর) গীতিকবিতা কী : পাশ্চাত্য সাহিত্যে ‘lyric’ নামে যাকে অভিহিত করা হয় বাংলায় সেটাই গীতিকবিতা। বস্তুত গীতি কবিতাগুলি ‘লির’ নামক বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গীত হতো বলেই তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘লিরিক’। ছন্দোবিশিষ্ট গীতিময় সাহিত্যিক রচনা যখন আনন্দদায়ক এবং চিত্তের সম্পূর্ণ ভাবব্যঞ্জক; সেই কাব্য বা কবিতা ‘গীতিকবিতা’ নামে অভিহিত হয়। অর্থাৎ আনন্দ বেদনা সুখ-দুঃখ প্রভৃতি মানবীয় অনুভূতি যখন ছন্দোবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়, তাকেই গীতিকবিতা বলা যায়।
গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য : গীতিকবিতার যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায় তা হলো— (ক) কবির ব্যক্তিগত অনুভুতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ; (খ) উল্লিখিত আবেগ ও অনুভূতির সংক্ষিপ্ত অথচ সংহত প্রকাশ; (গ) এখানে সাধারণত ব্যাক্তিগত অনুভূতিই প্রাধান্য পায়; (ঘ) সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হলো–গীতিকবিতার প্রধান উপাদান প্রেম।
ভাব সম্মিলন কবিতা সার্থক গীতিকবিতা : ব্যাখ্যা
বিদ্যাপতি রচিত আলোচ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটি গীতিকবিতার পর্যায়ভুক্ত কিনা তা এখন বিচার্য।
সাধারণত বৈষ্ণব পদাবলিকে গীতিকবিতা হিসেবে আখ্যাত করা হয়ে থাকে। তবে আধুনিক গীতিকবিতার যে বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লিখিত হলো তার নিরিখে বৈষ্ণব পদাবলিকে গীতিকবিতার মর্যাদা দেওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। কারণ বৈষ্ণব পদাবলিতে পদ রচয়িতাদের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়নি। তবে আমাদের পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটি যে একটি সার্থক গীতিকবিতা তা এখানে আলোচিত হলো।
গীতিকবিতার প্রধান উপাদান হলো প্রেম। শ্রীমতী রাধিকার ব্যাক্তিগত ভাবানুভূতি যেভাবে এই কবিতায় ফুটে উঠেছে তা গীতিকবিতার মুখ্য লক্ষণ তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। গীতিকবিতায় যে ধরনের ভাবচিত্র ও সুরঝংকার শোনা যায় আলোচ্য বৈষ্ণব পদটিতেও সেইরূপ চিত্র ও সুর একই সঙ্গে বেজে ওঠে। আলোচ্য পদটিতে গীতিকবিতার উপাদান সুপ্রচুর লক্ষ্যণীয়, যথা—
“পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।
পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।”
কিংবা,
“শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।”
শ্রীরাধিকার এই অকপট উক্তি পাঠকমনে যে আনন্দময় রসের উদ্ভব ঘটায়, তাতে আলোচ্য পদটি গীতিকবিতা রূপে প্রতিভাত হয়। রাধা-প্রেমের এই কবিতা যেন পার্থিব-প্রেমের সমসুরে বেজে ওঠে। আলোচ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় অপ্রাপ্যকে কল্পনার মধ্যে পেয়ে শ্রীরাধার যে আকুলতা, আনন্দোচ্ছ্বাস প্রাণময় রূপ পেয়েছে; তাতে পদটিকে একটি সার্থক গীতিকবিতায় উন্নীত করেছে।