BA MA বাংলাপ্রাক আধুনিক বাংলাবৈষ্ণব পদাবলি

পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে, বিদ্যাপতি, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)


পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।

মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।

পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে, বিদ্যাপতি, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)


মূলপদ

পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে।

মঙ্গল যতহুঁ করব নিজ দেহে।

বেদি করব হাম আপন অঙ্গনে।

ঝাঞ্জু করব তাহে চিকুর বিছানে।

আলিপনা দেওব মোতিম হার।

মজাল-কলস করব কুচভার।

কদলী-রোপব হাম গুরুয়া নিতম্ব।

আম্র-পল্লব তাহে কিঙ্কিণি সুঝম্প।।

দিশি দিশ আনব কামিনী-ঠাট।

চৌদিকে পসারব চাঁদক হাট।।

বিদ্যাপতি কহ পূরব আশ।

এক পলকে মিলব তুয়া পাশ।।


পূর্বসূত্র

এটি ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মেলনের পদ। ভাবোল্লাস হলো সম্ভোগ শৃঙ্গারের পরিণত অবস্থা। এই অবস্থায় সম্ভোগান্তক আনন্দময় স্মৃতিচারণ করা হয় বা ভবিষ্যৎ সম্মেলনের স্বপ্ন বোনা হয়। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলন-প্রত্যাশার কল্পনা অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এসব পদে। বৈষ্ণব শাস্ত্রকারেরা ভাব সম্মিলনকে সম্ভোগ শৃঙ্গারের অন্তর্গত করলেও আসলে এগুলি বিরহোম্মত্ত অবস্থায় কল্পনা মাত্র। বস্তুত জীবনে কৃষ্ণ মিলন সম্ভব নয়। কিন্তু শাস্ত্রকারেরা রাধা-কৃষ্ণের পক্ষে এমন অলৌকিক মিলনই যথার্থ বলে উল্লেখ করেছেন। আলোচ্য পদে বিদ্যাপতি সর্বদেহ দিয়ে শ্রীরাধা কেমন করে কৃষ্ণকে সম্বর্ধনা করবেন, তারই বর্ণনা করেছেন।

আরো পড়ুন :  ঘরের বাহিরে দন্ডে শতবার, চণ্ডীদাস, পূর্বরাগ

পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা :

  • পিয়া যব … নিজ দেহে : কেউ বাড়িতে এলে তাকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে অভ্যর্থনা ভারতীয় রীতি। এরপর তাকে আহার্য ও আসন দিতে হয়। আলোচ্য পদে কবি শ্রীরাধার জবানীতে, তিনি কীভাবে অভ্যর্থনা করবেন তা বর্ণনা করেছেন। শ্রীরাধা বলছেন, যিনি যত মঙ্গলাচরণ করবেন, সবই নিজের দেহ দিয়েই। সর্ব উপচার যেন তাঁর দেহে সঞ্চিত হয়ে আছে। 
  • বেদি করব … অঙ্গনে : কৃষ্ণ এলে কোন বেদিতে বসতে দেবেন রাধা? তিনি বলছেন, আমার দেহই হবে তাঁর বসবার বেদি। 
  • ঝাঞ্জু করব … বিছানে : আমার চুলের রাশি হবে ঝাঁটা। তা দিয়ে আমি বেদি ও প্রাঙ্গণ পরিচ্ছন্ন করে রাখব।
  • আলিপনা … মোতিম হার : তেমনি সম্মানীয় অতিথি এলে আলপনা দিয়ে অভ্যর্থনা মঞ্চ সাজাতে হয়। শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে সম্মানীয় অতিথি আর কে হতে পারেন? তাকে যদি দেহ দিয়েই অভ্যর্থনা করা হয়, তবে আলপনা হবে কি? রাধা বলছেন, আমার হারই হবে আলপনা। 
  • মঙ্গল কলস … কিঙ্কিণি সুঝম্প : মঙ্গলাচারের জন্য গৃহদ্বারকে মঙ্গল কলসে, কলা গাছে, আম্রপল্লবে সাজান হবে। শ্রীরাধা দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে এসব মঙ্গল চরণের উপকরণ ভাবছেন। তাঁর কুচযুগ কুম্ভ তুল্য। একেই তাই রাধা মঙ্গল-কলস বলেছেন। রমণের আদিতে কুচ মন্থন—বাস্তব দিক থেকেও তা গৃহদ্বার প্রান্ত। কবিরা চিরকাল নারী নিতম্বকে কদলী বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাধাও তাঁর নিতম্বদ্বয়কে অভ্যর্থনার্থে রোপিত কলাগাছ রূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আম্রপল্লব? কল্পনায় বাধেনি যে, ওই পায়ে তাঁর যে নূপুর রয়েছে, যা অবিরাম কিঙ্কিণি ধ্বনি তোলা, তাই হবে তাঁর আম্রপল্লব। 
  • দিশি দিশি … চাঁদকে হাট : সখি গো, তোমরা প্রশ্ন করতে পার, অভ্যর্থনার জন্য তো শত শত নারীর উপস্থিতি প্রয়োজন। তা তুমি করবে কীভাবে? শ্রীমতী বলছেন, তিনি, একাই শত রমণী হয়ে কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা করবেন। তিনি যে সব রমণীয় ভঙ্গি ও বিচিত্র বিলাসকলা বিস্তার করবেন, তাতেই মনে হবে বহু রমণীর সমাবেশ হয়েছে। একাই তিনি কৃষ্ণের চতুর্দিকে চাঁদের হাট বসিয়ে দেবেন। 
  • বিদ্যাপতি কহ … তুয়া পাশ : বিদ্যাপতি বলছেন, তোমার মন যদি এতদূর প্রস্তুত তবে তোমার আশা পূর্ণ হবেই। কৃষ্ণ অনতিবিলম্বে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন।
আরো পড়ুন :  অব মথুরাপুর মাধব গেল, বিদ্যাপতি, মাথুর

পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে পদটির সামগ্রিক অর্থ

প্রিয় যখন আমার গৃহে আসবেন, নিজ দেহ দিয়েই আমি তাঁর মঙ্গলাচরণ করব। আমার অঙ্গকে করব বেদি, সম্মার্জনী করব আমার চুল। আমার মোতির হার হবে আলপনা। গুরুভার কুচযুগ হবে মঙ্গল কলস। আমার গুরু-নিতম্বদ্বয় হবে যেন রোপিত-কদলীবৃক্ষ আর তার ওপর আম্রপল্লব হবে আমার নূপুর। আমি অজস্র রমণীর ভঙ্গিমায় শ্রীকৃষ্ণের সর্বদিকে পূর্ণ করে তুলব।  যেন মনে হবে সর্বদিকে চাঁদের হাট বসেছে। বিদ্যাপতি বলছেন, তোমার আশা পূর্ণ হবে। এক পলকেই (তিনি) তোমার পাশে মিলিত হবেন।

আরো পড়ুন :  বঁধু কি আর বলিব আমি, চণ্ডীদাস, নিবেদন

পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে পদটির তাৎপর্য

পদটিতে সম্ভোগের বিশদ বর্ণনা। কোথাও তা বাস্তব রমণকে স্পষ্ট করে তুলেছে। পদটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবির বৈষ্ণব পদাবলীর টীকাকার লিখেছেন, “তত্ত্বের দিক দিয়া দেখিলে এই পদটিতে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলন প্রসঙ্গ আছে বালিয়া মনে হয়। এখানে সাধকের এই মঙ্গল-আচারের স্থান … The human body is the highest temple of God. এই উক্তির সার্থকতা এই কবিতাটিতে দৃষ্ট হইবে। রসের দিক দিয়া দেখিলে এই পদে, বহুদিন পরে বন্ধুর আগমনের আশায় নায়িকার অপূর্ব ভাবোল্লাস বা মিলনানন্দের কল্পনা সূচিত হইয়াছে।”


কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে এই লেখাগুলো পড়া যেতে পারে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!