অব মথুরাপুর মাধব গেল, বিদ্যাপতি, মাথুর
অব মথুরাপুর মাধব গেল : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
অব মথুরাপুর মাধব গেল, বিদ্যাপতি, মাথুর
মূলপদ
অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল মাণিক কো হরি লেল।
গোকুলে উছলল করুণাক রোল।
নয়নক জলে দেখ বহএ হিল্লোল।।
সুন ভেল মন্দির সুন ভেল নগরী।
সুন ভেল দশ দিস সুন ভেল সগরী॥
কৈসনে যাওব যামুন তীর।
কৈসে হেনারব কুঞ্জ কুটীর॥
সহচরি সঞে জঁহা কয়ল ফুলখেরি।
কৈসে আয়ব তাহি নেহারি।।
বিদ্যাপতি কহ কর অবধান।
কৌতুক ছাপিত তঁহি রহুঁ কার।।
অব মথুরাপুর মাধব গেল পদটির শব্দার্থ
অব = এখন।
কো = কে।
হরি = হরণ করে।
উছলল = উচ্ছলিত হল, উথলে উঠল।
করুণাক = কান্নার, শোকের।
রোল = রব, চিৎকার।
হিলোল = তরঙ্গ, ঢেউ।
সুন = শন্য।
মন্দির = শয়ন ঘর।
ভেল = হল।
সগরি = সকলি।
কৈছনে = কেমন করে।
যায়ব = যাব।
কৈছে = কেমন করে।
নেহারব = দেখব।
কুঞ্জুকুটির = উপবন গৃহ।
সহচরী = সখী।
সঞে = সঙ্গে।
কয়ল = করল।
ফুলখেরি = ফুলখেলা।
জীয়ব = বেঁচে থাকব।
নেহারি = দেখে।
সাবধান = বোঝ।
কৌতুকে = আমোদে, রহস্যে।
ছাপি = ঢেকে দিয়ে।
তঁহি = সেখানে।
কান = কানু।
যামুন = যমুনা নদী।
রহুঁ = আছে, থাকে।
অব মথুরাপুর মাধব গেল পদটির নিবিড় পাঠ
- অব মথুরাপুর … লেল : অক্রুরের রথে চড়ে কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেন। তাঁর অন্তর্ধানে সমগ্র বৃন্দাবন যেন সহসা নিঃস্ব হয়ে গেল। কেননা, কৃষ্ণ ছিলেন বৃন্দাবনবাসীর কাছে বহুমূল্য মাণিক্য রত্নবিশেষ। বহু মূল্যবান মাণিক্য চুরি গেলে গৃহস্থ যেমন রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পড়ে, ব্রজবাসীদেরও সেরূপ অবস্থা দেখা দিল।
- গোকুলকে … হিলোল : কানু ছিলেন গোকুলের মাণিক, প্রাণধন বিশেষ। কঠিন কর্তব্যের তাগিদে তিনি অঙ্কুরের রথে চড়ে বৃন্দাবন ছেড়ে মাথায় চলে গেলেন। তাঁর বিহনে বৃন্দাবনবাসীদের মধ্যে প্রিয়তম জনের বিচ্ছেদ-বেদনায় অতলান্ত কান্নার রোল উঠল। এত চোখের জল ঝরতে লাগল যে নদীর স্রোত বইত থাকল।
- সুন ভেল … সগরী : প্রাণ অন্তর্হিত হলে যেমন অসাড় দেহ পড়ে থাকে, কানুকে হারিয়ে ব্রজবাসীদের মনের অবস্থা বিশেষ করে শ্রীরাধার মনের অবস্থা, সেরূপ নীরস, উষর, ধূসর, নিরানন্দ হয়ে পড়ল। একটা নিঃসীম শূন্যতার বেদনা সকলের হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে তুলল। কানুকে হারিয়ে রাধারাণী যেন আরও বেশি করে বুঝতে পারলেন, যে কানু তাঁর কতটা হৃদয়সর্বস্ব ধন ছিলেন। তাই দিকদিগন্ত পরিপ্লাবিত একটা অপরিসীম শূন্যতার বেদনা তাঁকে বিদ্ধ করতে থাকল। শয়ন মন্দির, নগরী, দশদিক-কোথাও কানুকে আর দেখা যাচ্ছে না।
- কৈসনে যাওব … কুটীর : কী করে এখন যমুনাতীরে যাবো? আর কী করেই বা এখন কুঞ্জ-কুটীরের দিকে তাকাবো? বস্তুত, শ্রীরাধিকার পক্ষে কানুবিহীন যমুনাতীর বা কুঞ্জ-কুটীরের দিকে গমন বরং শাস্তিস্বরূপ। যমুনাতীরে বা কুঞ্জ-কুটীরে কানুর সঙ্গে তাঁর কত মিলন-মধুর আবেশবিহ্বল মুহূর্ত কেটেছে রভসলীলায়। প্রাণপ্রিয় সেই কানু আজ কত দূরে চলে গেছেন তাঁকে ছেড়ে। তাই যমুনাতীরে বা কুঞ্জকুটীরে গেলে সেই পুরানো মধুর স্মৃতির কথা তাঁকে মনে করিয়ে বর্তমানের বিরহের বেদনাকে আরও উচ্চকিত করে তুলবে। আর সেটা হবে রাধার পক্ষে নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক।
- বিদ্যাপতি … রহুঁ কার : প্রবল বিরহ যন্ত্রণাকাতরা রাধাকে সখীভাবে ভাবিত বিদ্যাপতি এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন যে, হে রাধে, তুমি মনোনিবেশ করে শোনো, কৃষ্ণ তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছেন ভেবে তুমি বিরহ অত কাতর হোয়ো না, অত ভেঙে পোড়ো না, কানু ওইখানেই অর্থাৎ আশেপাশে কোথাও কৌতুকছলে লুকিয়ে আছে। (সুতরাং তুমি তাঁর দেখা পাবে।)
অব মথুরাপুর মাধব গেল পদটির পদটির আলোচনা
‘মাথুর’ বিরহের এই পদটিতে শ্রীমতীর অন্তহীন বিরহ-বেদনার উচ্চকিত সুর ঝংকৃত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। কৃষ্ণই তাঁর ধ্যান কৃষ্ণই তাঁর জ্ঞান। কৃষ্ণই তাঁর সর্বসুখের আকর। সহসা তাঁকে ফেলে কৃষ্ণ কর্তব্যের ভূমি মথুরায় চলে গেলেন। আনন্দের লীলাভূমি এক মুহূর্তে চরম বিষাদের মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। রাধা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মন্দিরে, নগরীতে, যমুনাতীরে, কুঞ্জ-কুটীরে কোথাও কৃষ্ণ নেই। প্রাণের আনন্দস্বরূপ কৃষ্ণকে হারিয়ে রাধা অসাড়। কবি বিদ্যাপতি তুলির কয়েকটি মাত্র আঁচড়ে রাধার এই অন্তহীন বিরহবেদনাকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বল্পাক্ষরে অলংকৃত এই বাণী কি আশ্চর্য রসনিষ্ঠ শিল্পমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে, তা বলাই বাহুল্য।
কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে এই লেখাগুলো পড়া যেতে পারে