অন্ধকার লেখাগুচ্ছ – শ্রীজাত, উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণি তৃতীয় সেমিস্টার
অন্ধকার লেখাগুচ্ছ – শ্রীজাত, উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণি তৃতীয় সেমিস্টার : শ্রীজাত রচিত অস্থির সময়ের একটি কবিতা অন্ধকার লেখাগুচ্ছ।
অন্ধকার লেখাগুচ্ছ কবিতার MCQ আলোচনা হয়েছে।
অন্ধকার লেখাগুচ্ছ – শ্রীজাত, উচ্চমাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণি তৃতীয় সেমিস্টার
অন্ধকার লেখাগুচ্ছ – শ্রীজাত
১৪
সনেট
আবদুল করিম খাঁ-র ধর্ম ছিল গান।
আইনস্টাইনের ধর্ম দিগন্ত পেরনো।
কবীরের ধর্ম ছিল সত্যের বয়ান।
বাতাসের ধর্ম শুধু না-থামা কখনও।
ভ্যান গঘের ধর্ম ছিল উন্মাদনা। আঁকা।
গার্সিয়া লোরকা-র ধর্ম কবিতার জিত।
লেনিনের ধর্ম ছিল নতুন পতাকা।
আগুনের ধর্ম আজও ভস্মের চরিত।
এত এত ধর্ম কিন্তু একই গ্রহে থাকে।
এ-ওকে, সে-তাকে আরও জায়গা করে দেয়।
তবে কেন অন্য পথ ভাবায় তোমাকে?
তোমার ধর্মের পথে কেন অপব্যয়?
যে তোমাকে শিখিয়েছে দখলের কথা –
জেনো সে ধর্মই নয়। প্রাতিষ্ঠানিকতা।
কবিতায় উল্লিখিত বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো –
বিখ্যাত ব্যক্তি | তাঁদের পরিচয় |
আবদুল করিম খাঁ | উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ (১১ নভেম্বর ১৮৭২ – ২৭ অক্টোবর ১৯৩৭) ছিলেন একজন ভারতীয় হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী। অন্যতম সারেঙ্গী বাদক। কিরানা বা কৈরনা ঘরানার প্রবর্তক। |
আইনস্টাইন | আলবার্ট আইনস্টাইন (১৪ মার্চ ১৮৭৯ – ১৮ এপ্রিল ১৯৫৫) জার্মানিতে জন্ম গ্রহণকারী একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি মূলত আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। তিনি ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। |
কবীর | মুসলমান জোলার পুত্র কবীর ছিলেন চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের ভারতের একজন কবি। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা বলেছেন। তার রচনা ভক্তি আন্দোলনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাঁর কবিতা দোঁহা নামে পরিচিত। |
ভ্যান গঘ | ভিনসেন্ট উইলেম ভ্যান গঘ (৩০ মার্চ ১৮৫৩ – ২৯ জুলাই ১৮৯০) ছিলেন একজন ডাচ (নেদারল্যান্ড) চিত্রশিল্পী। ৩৭ বছর বয়সে আত্মঘাতী বন্দুকের গুলিতে মারা যান। তাঁর জীবদ্দশায়, কেবলমাত্র একটি চিত্রকর্ম ‘দ্য রেড ভাইনইয়ার্ড’ বিক্রি হয়েছিল। তিনি পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের শিল্পী। |
গার্সিয়া লোরকা | ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা স্প্যানিশ (স্পেন) সাহিত্যের অন্যতম কবি। তিনি একাধারে একজন কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক ছিলেন। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের (১৯৩৬) শুরুর দিকে জাতীয়বাদী কর্মিরা তাকে হত্যা করে। তাঁকে স্পেনে ‘জনগণের কবি’ বলে ডাকা হয়। |
লেনিন | ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে লেলিন (২২ এপ্রিল, ১৮৭০ – ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) হলেন একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী। বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। লেনিন ১৯১৭ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তাঁর মতবাদ লেনিনবাদ নামে পরিচিত হয়। |
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায় অর্থাৎ ‘কর্মযোগ’ অধ্যায়ের কর্মের জয়গান গাওয়া হয়েছে। সেখানে কর্মই ধর্ম। যেকোনো মানুষ তাঁর কর্মের মধ্যে দিয়ে সমাজের কল্যাণ করতে পারেন। তিনি যদি তার কর্মে অবিচল থেকে সত্যনিষ্ঠায় ব্যাপৃত থেকে কর্ম করেন তবে তিনি নিশ্চিত প্রকৃত ধার্মিক।
কবি শ্রীজাত-র আলোচ্য ‘অন্ধকার কবিতাগুচ্ছে’র ১৪ নম্বর সনেটেও সেই বার্তা প্রকাশ পেয়েছে। যাঁরা বিখ্যাত ছিলেন, তাঁদের কিন্তু তথাকথিত কোনো ধর্মের ধ্বজা বহন করতে হয়নি। তাঁরা কোনো বিশেষ ধর্মের সোপানও ব্যবহার করেননি। তাঁরা কেবল নিজ কর্ম করে গেছেন। সত্যের প্রতি তাঁদের একনিষ্ঠতা তাঁদের মহান করেছে। কবির মতে তাঁরা-ই প্রকৃত ধার্মিক।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস, সমাজকল্যাণ – এগুলিই তো ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য। যখন তথাকথিত ধর্মের আচার-আচরণে মানুষের সম্মান, ভালোবাসা ভূ-লুন্ঠিত হয়, তখন কবি অলক্ষ্যে কাঁদেন। তিনি নজির দেখিয়ে জানান দেন প্রকৃত ধর্মের স্বরূপকে। যথাযথ ধর্ম আসলে কী – তার পরিচয় দেন।
কবি তথাকথিত ধর্মের পথকে পরিহার করে সত্যের পথে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃত ধর্মবোধ অপরের স্বাধীনতাকে দখল করার শিক্ষা দেয় না। প্রাতিষ্ঠানিকতা তো রাষ্ট্রযন্ত্রের নামান্তর, যে শুধুমাত্র শোষণ-অত্যাচারে সিদ্ধহস্ত। যে তথাকথিত ধর্ম মানুষের ইচ্ছাকে পদদলিত করে, কুশিক্ষার মাধ্যমে অপরকে দখলের পরামর্শ দেয়, তা প্রকৃত ধর্ম হতে পারে না।