সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, জ্ঞানদাস, আক্ষেপানুরাগ (প্রেমবৈচিত্ত্য)
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, জ্ঞানদাস, আক্ষেপানুরাগ (প্রেমবৈচিত্ত্য)
মূলপদ
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল ৷৷
সখি কি মোর করমে লেখি।
শীতল বলিয়া ও চাঁদু সেবিনু
ভানুর কিরণ দেখি ।।
উচল বলিয়া অচলে চড়িতে
পড়িনু অগাধ জলে।
লছিমী চাহিতে দারিদ্র্য বেঢ়ল
মাণিক হারানু হেলে ৷৷
নগর বসালাম সাগর বাঁধিলাম
মাণিক পাবার আশে।
সাগর শুকাল মাণিক লুকাল
অভাগীর করম-দোষে॥
পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু
বজর পড়িয়া গেল।
জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি
মরণ অধিক শেল।।
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু পদটির পূর্বসূত্র
এটি একটি আক্ষেপানুরাগ বা প্রেম-বৈচিত্ত্যের পদ। এ পদে শ্রীরাধার আক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে। যা চেয়েছিলেন রাধা ঠিক তার বিপরীত ব্যাপার লাভ করেছেন। কৃষ্ণপ্রেম তাঁকে আনন্দিত, তৃপ্ত ও পূর্ণ করবে এই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। কিন্তু তিনি হয়েছেন বিষণ্ণ, অতৃপ্ত ও খণ্ডিত। এই বেদনাই আলোচ্য পদের বিষয়বস্তু।
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
- সুখের লাগিয়া … গরল ভেল : সুখ প্রত্যাশা করেই কৃষ্ণের সঙ্গে প্রেমের ঘর বেঁধেছিলেন রাধা। কিন্তু সে ঘর আগুনে পুড়ে গেল। অর্থাৎ তা শুধু উদ্বেগ অশান্তি ও অনাশ্রয়ের কারণ হল। কৃষ্ণ প্রেম তো পরমানন্দের আশ্রয়। কিন্তু রাধার কপালে তা বিষ হয়ে উঠেছে। কলঙ্ক, গঞ্জনা, উৎকণ্ঠা তা অবিরাম নৈরাশ্য সার হয়েছে। এই পদের প্রত্যেক চরণেই এই এক বক্তব্য-নানা উপমান অবলম্বনে লেখা হয়েছে।
- সখি কি মোর … কিরণ দেখি : ওগো সখিরা। আমার কর্মের বিপাক দেখেছ। আমি শীতল ভেবে চাঁদের কিরণ পান করলাম; কিন্তু আদতে তা সূর্যকিরণ। এখনই তাই আমার সর্ব দেহ জর্জর হয়ে গেল।
- উচল বলিয়া … হারানু হেলে : হে সখিরা, শোন আমার দুঃখের কথা। আমি উচ্চে অবস্থান করতে চেয়েছিলাম। তাই উঠতে গেলাম পাহাড়ে। পড়লাম অগাধ জলে। আমি লক্ষ্মীর আশীর্বাদ চেয়েছিলাম, কিন্তু যা করলাম তাতে হাতের মাণিকটিও হারালাম, অন্যদিকে দারিদ্র্য বেষ্টন করল।
- নগর বসালাম … করম দোষে : কৃষ্ণ-প্রেমে রাধার ত্যাগে কাকে নগর বসান বলা যায় তা বোঝা মুস্কিল। তবে নগর বসালাম, সাগর বান্ধিলাম কথা দুটি দিয়ে সে অসাধ্য-সাধন করেছেন—বোঝান হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই অসাধ্য সাধনের এক লক্ষ্য-মাণিক প্রাপ্তি। মাণিক কে বা কি? এখানে মাণিক বলতে নিশ্চয় কৃষ্ণকে বোঝান হয়েছে। এক কৃষ্ণকে পাবার আশায় রাধা সব অসাধ্য সাধন করেছেন। কিন্তু রাধার কর্মদোষেই বিপরীত অসম্ভব ঘটল—’সাগর শুকাল’, ‘মাণিক লুকাল’। এরপর রাধাকে অভাগী ছাড়া আর কি বলা যাবে?
- পিয়াস লাগিয়া … অধিক শেল : শ্রীরাধা নিজেকে চাতকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। চাতক সহজলভ্য জল পান করে না। তৃষ্ণা পেলে সে মেঘবারির জন্য অপেক্ষা করে–পায়ও। শ্রীরাধাও কোনো সাধারণের প্রেম চাননি। তিনি কৃষ্ণপ্রেমের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলেন। কিন্তু এমনই কপাল তাঁর যে তার মেঘসম কৃষ্ণ জল দেবার পরিবর্তে দিলেন বজ্রাঘাত। জ্ঞানদাস বলছেন, শ্রীমতী রাধা! তোমাকে কি বলে সান্ত্বনা দেব। তুমি কি জান না, কানুর প্রীতি মৃত্যুতুল্য শেল যন্ত্রণা দেয়।
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু পদটির সামগ্রিক অর্থ
সুখ চেয়ে এ ঘর বাঁধলাম, আগুনে পুড়ে গেল। অমৃত সাগরে স্নান করতে সবই আমার বিষ হয়ে উঠল। সখি, আমার কর্মে কি যে লেখা আছে। শীতল বলে ও চাঁদ পান করলাম, কিন্তু তা যে সূর্যের কিরণ। উঁচুত উঠব বলে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে অবাধ জলে পড়ে গেলাম। লক্ষ্মী চাইলাম, দারিদ্র্য আমায় ঘিরে ধরল, অবহেলায় মাণিক হারালাম। মাণিক পাবার আশায় নগর বসালাম, সাগর বাঁধলাম—সাগর শুকাল, মাণিক লুকায়—সবই দুর্ভাগ্য আমার কর্মদোষ। পিপাসা লাগায় মেঘবারি পান করতে চাইলাম—পড়ল বজ্র। জ্ঞানদাস বলছেন, কৃষ্ণের প্রীতি এমন মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণাই দেয়।
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু পদটির তাৎপর্য
এই বিখ্যাত পদটিতে কবি জ্ঞানদাস কৃষ্ণপ্রেমকে নানা উপমানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুখের ঘর বাঁধা, অমিয় সাগরে স্নান করা, শীতলচন্দ্র কিরণ সেবন করা, পর্বত আরোহণ করা, লক্ষ্মী প্রার্থনা করা, নগর বসান বা সাগর বাঁধা, পিপাসা মেটাতে মেঘবারি পান করা ইত্যাদি সবই কৃষ্ণে প্রেমাসক্ত হওয়াকে বুঝিয়েছেন। শ্রীমতী রাধা কৃষ্ণপ্রেমের পরিবর্তে পারিবারিক সুখ হারিয়েছেন, গৃহত্যাগ করতে হয়েছে, কলঙ্ক ও গঞ্জনা সার হয়েছে। অবিরাম কৃষ্ণকে আপন করে পাবার আকাঙ্ক্ষাও তৃপ্ত হয়নি। এই দুই ফলকে আগুনে ঘর পোড়া, সব বিষ হয়ে যাওয়া, চাঁদের কিরণ আসলে সূর্যকিরণে পরিণত হওয়া, গভীর জলে পড়ে যাওয়া, দারিদ্র্যবেষ্টিত হওয়া, মাণিক হারান, সাগর শুকান, মাণিক লুকান এবং বজ্রপাত হওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
বাহ্য দৃষ্টিতে ও লৌকিক বিচারে কৃষ্ণপ্রেম মরণ-যন্ত্রণাদায়ক। ভক্ত যে প্রশান্তি ও আনন্দ বোধ করেন বাইরের অভিব্যক্তিতে তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।
“পদাবলির কবি জ্ঞানদাস” সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটি পড়া যেতে পারে