মাধব বহুত মিনতি করি তোয়, বিদ্যাপতি, প্রার্থনা
মাধব বহুত মিনতি করি তোয় : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
মাধব বহুত মিনতি করি তোয়, বিদ্যাপতি, প্রার্থনা
মুলপদ
মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিলুঁ
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।।
গণইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি
যত তহুঁ করবি বিচার।
তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ বাহির নহ মুঞি ছার।
কিয়ে মানুষ পশু পাখি কিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীট পতঙ্গ।
করম-বিপাকে গতাগতি পুন পুন
মতি রহ তুয়া পরসঙ্গ।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু।
তুয়া পদপল্লব কবি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু।।
পূর্বসূত্র
এটি একটি প্রার্থনার পদ। প্রার্থনার পদে সাধারণত শ্রীকৃষ্ণকে সর্বৈশ্বর্যশালী নিত্য বস্তুরূপে কল্পনা করা হয়। এই নিত্যবস্তুতে প্রতিষ্ঠিত ভক্ত মন বিষয়-বাসনাদি ত্যাগ করে ঐকান্তিক নিষ্ঠায় তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করেন। এ অবস্থায় ভক্ত ভগবানে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে না। এই পদে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার আবরণ নেই। এসব পদের রসকে শান্তরস বলা হয়। স্থায়ীভাবে ‘শম’ নামে রতি। এ চিন্তা গৌড়ীয়বৈষ্ণব ধর্মমত বিরুদ্ধ। প্রাক্-চৈতন্য যুগে এ জাতীয় পদ রচিত হয়েছে।
মাধব বহুত মিনতি করি তোয় পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
মাধব : মধু + ষ্ণ = মাধব। মধু বংশে জাত বলে কৃষ্ণকে মাধব বলা হয়। আবার মার (লক্ষ্মীর) ধব (পতি) বলেও তাঁকে মাধব বলা হয়। শ্রীবিষ্ণু বা বিষ্ণুর যেকোনো অবতার বিশেষত শ্রীকৃষ্ণই মাধব।
বহুত … তোয় : হে কৃষ্ণ, তোমার নিকট আমি বারম্বার মিনতি করি।
দেই তুলসী … ছোড়বি মোয় : তিল-তুলসী স্পর্শ করে কোনো কিছু দান করার অর্থ নিঃশর্তে দান করা। এখানে ভক্ত নিজেকে তিল-তুলসী দিয়ে কৃষ্ণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছেন। কৃষ্ণের কাছে তাঁর মিনতি, এই প্রদত্ত বস্তু যেন তিনি ত্যাগ না করেন।
গণইতে দোষ … করবি বিচার : হে কৃষ্ণ, তুমি যদি আমার বিচার করতে বস, তবে আমার মধ্যে গুণলেশ মাত্র পাবে না, সবই দোষময়। অর্থাৎ বিচারে বরণীয় বলে গৃহীত না হতেও পারেন।
তুঁহু জগন্নাথ … মুঞি ছার : তবু হে দেব, হে কৃষ্ণ, তোমাকে তো জগতের নাথ বলা হয়। জগতের সকল কিছুরই অধিপতি তুমি। এই তত্ত্বই তো জগতে প্রচারিত। আর তা যদি সত্য হয়, তবে আমিও তো জগতের বাইরের কিছু নই। অতএব আমার গুণ থাকুক না থাকুক, আমি পরিত্যক্ত হতে পারি না। সমর্পিত আমাকে গ্রহণ না করে তোমার গতি নেই।
কিয়ে মানুষ পশু … তুয়া পরসঙ্গ : জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী কবি বা ভক্ত বলছেন যে কর্ম-বিপাকে আমি পশু পাখী বা কীট- পতঙ্গ, যে কুলেই জন্মাই না কেন, যতবারই আমাকে যে যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হোক, সে যোনি উচ্চতরই হোক আর নিম্নবর্গেরই হোক, তোমার প্রসঙ্গে যেন আমার চিত্ত ও মনন নিবদ্ধ থাকে।
ভণয়ে বিদ্যাপতি … দেহ দীনবন্ধু : এসব কথা কবি কেন লিখেছেন তার বিবৃতি এই শ্লোকে। কবি এই ভবসিন্ধু দেখে কাতর। তিনি এ সিন্ধু পার হতে আগ্রহী। কিন্তু পার হবার উপায় কি? খরস্রোতে বাহিত পাতায় উঠে সামান্য পিঁপড়েও নিরাপদে নদী পার হতে পারে-হে কৃষ্ণ, এ ভবসিন্ধু পার হতে তেমন আশ্রয় তোমার পদ-পল্লব। তোমার সেই পদপল্লবই আমি আশ্রয় করলাম। হে পতিত-জনের বান্ধব! নিশ্চয়ই তুমি আমাকে পদাশ্রয় বঞ্চিত করবে না।
মাধব বহুত মিনতি করি তোয় পদটির সামগ্রিক অর্থ
হে মাধব। তোমাকে আমি বহু মিনতি করছি। তিল তুলসী দিয়ে এ দেহ সমর্পণ করলাম। তুমি দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না। যখন তুমি বিচার করতে বসবে দোষ গুণতে গেলে গুণ লেশমাত্র পাবে না। কিন্তু এ জগতে বলে তুমি জগন্নাথ। যত সামান্যই হই আমি তো জগতের বাইরের বস্তু নই। কর্ম বিপাকে জীবের বারম্বার জন্মান্তর ঘটে। আমিও মানুষ কীট-পশু পাখী নানা রূপে জন্মাতে পারি। যে রূপেই জন্মাতে হোক, তোমার প্রসঙ্গে যেন আমার মতি থাকে। এই ভাব সিন্ধু পার হবার জন্য অতিশয় কাতর হয়ে বিদ্যাপতি বলছেন, হে দীনবন্ধু! তোমার পদপল্লব আশ্রয় গ্রহণ করলাম-আমাকে এক তিল পরিমাণ করুণা দিও।
মাধব বহুত মিনতি করি তোয় পদটির তাৎপর্য
সর্বৈশ্বর্যময় কৃষ্ণই একমাত্র ভবসিন্ধু থেকে জীবকে তরাতে পারেন এই বিশ্বাসে কবি বা ভক্ত তিনটি মিনতি করছেন। এক, তিনি যেন কিছুতেই ভক্ত আত্মা ত্যাগ না করেন। দুই, কর্মবিপাকে যে যোনিতেই জন্ম হোক জীবাত্মা যেন কৃষ্ণ প্রসঙ্গ বিস্মৃত না হয়। তিন, ভক্ত তার পাদপল্লবকে আশ্রয়মাত্র জ্ঞান করলে কৃষ্ণ যেন তাকে ত্যাগ না করেন। ভক্তের ঐকান্তিক সমস্ত প্রার্থনাই এখানে অভিব্যক্ত। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবাদর্শ এখানে অনুসৃত নয়।
কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে এই লেখাগুলো পড়া যেতে পারে