বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে, চণ্ডীদাস, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে, চণ্ডীদাস, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)
মূলপদ
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।
এতেক সহিল অবলা বলে।
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হলে।।
দুখিনীর দিন দুঃখেতে গেল।
মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল।।
এসব দুঃখ কিছু না গণি।
তোমার কুশলে কুশল মানি।।
সব দুখ আজি গেল হে দূরে।
হারানো রতন পাইলাম কোরে।
কোকিল আসিয়া করুক গান।
ভ্রমরা ধরুক তাহার তান।।
মলয় পবন বহুক মন্দ।
গগনে উদয় হউক চন্দ।
বাশুলী আদেশে কহে চণ্ডীদাসে।
দুঃখ দূরে গেল সুখ বিলাসে।
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে পদটির পূর্বসূত্র
আলোচ্য পদটি ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলনের। দুঃখিনী শ্রীরাধিকার অন্তর্বেদনা এখানে প্রকাশ পাচ্ছে।
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে পদটিরশব্দার্থ
- বহুদিন … গেলে : বহুদিন পর শ্রীকৃষ্ণের আগমন। কিন্তু রাধার প্রাণ গেলে তাহলে আর দেখা হোত না।
- এতেক সহিল … হলে : তোমার বিরহে আমি যে কি পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তা আমি অবলা নারী বলেই সম্ভব হয়েছে। এত দুঃখ-কষ্ট কোনো পাষাণও সহ্য করতে পারত না—তা ফেটে চুরমার হয়ে যেত। পাষাণও সহ্য করতে পারত না, আমি অবলা নারী বলেই সহ্য করেছি—এই নিতান্ত সাদামাটা, অথচ অতি গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত উক্তির মধ্যেই রাধা যে কি অপরিসীম বিচ্ছেদ-বেদনা সহ্য করেছেন, তা ব্যঞ্জিত হয়েছে।
- দুঃখিনীর দিন … ভাল : তোমার বিরহে দুঃখিনী রাধার দিন অতি দুঃখে কেটেছে। কিন্তু তুমি মথুরা নগরে কুশলে ছিলে তো? শ্রীরাধা অতি শান্ত ও সংযত ভাষায় নিজের নিদারুণ বিরহ-যন্ত্রণার কথা জানালেন যে, দুঃখেই তার কাল কেটেছে। কিন্তু নিজের দুঃখ কাহিনি ব্যাখ্যান অপেক্ষা রাধার মনে কৃষ্ণের কুশল জিজ্ঞাসাই প্রধান হয়ে উঠল। রাধার কৃষ্ণপ্রীতির আত্যন্তিকতার আধিক্য এখানে লক্ষ্য করবার বিষয়।
- এসব দুঃখ … মানি : রাধা নিজের দুঃখ-কষ্টকে বড়ো বলে মনে করেন না। তিনি কৃষ্ণগতপ্রাণা। কৃষ্ণের সুখ-দুঃখকেই তিনি নিজের বলে জানেন। তাই কৃষ্ণ কুশলে থাকলেই রাধা তা নিজের কুশল বলে জানবেন।
- সব দুখ আজি … কোরে : কৃষ্ণ-বিরহে রাধা এতদিন নিদারুণ দুঃখের মধ্যে কাল কাটাচ্ছিলেন। কেন না কৃষ্ণই তো তাঁর জীবনের সবকিছু। সুতরাং কৃষ্ণবিচ্ছেদ তাঁর চরমতম বেদনার উৎস। কৃষ্ণকে হারানো মানে সব হারানো, তাঁর সঙ্গে মিলনের অর্থ জীবনের তাৎপর্য সৌন্দর্য, মাধুর্য, সবকিছু ফিরে পাওয়া। রাধার তাই এই মুহূর্তে সব দুঃখ-বেদনা অন্তর্হিত। তিনি তাঁর হারানো মাণিককে অর্থাৎ কৃষ্ণকে নিজের ক্রোড়ে ফিরে পেয়েছেন।
- কোকিল আসিয়া … চন্দ : কৃষ্ণকে হারিয়ে রাধার দুঃখের অন্ত ছিল না। এখন তাঁকে ফিরে পেয়ে সব দুঃখ-কষ্টের অবসান হয়েছে। হারানো রত্নকে তিনি ফিরে পেয়েছেন। তাই এখন দিকদিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছে আনন্দের কলতান। সেই আনন্দের পরিবেশকে আরও ভরে তুলুক কোকিলের গান, ভ্রমরের তান, মৃদুমন্দ মলয় পবন, গগনের পূর্ণচন্দ্র।
- বাশুলী আদেশে … বিলাসে : বাশুলী আদেশে চন্ডীদাস বলছেন, এখন সুখ-বিলাসে দুঃখ দূরে গেল। এতদিন দুঃখের অন্ত ছিল না। এখন সুখের উদয় ঘটেছে। মিলনের আনন্দে চতুর্দিকে পরিপূর্ণ। তাই দুঃখ অন্তর্হিত হয়েছে।
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে পদটির আলোচনা
চণ্ডীদাস-কৃত ভাবসম্মিলনের এই পদটিতে রাধার মনঃপ্রকৃতির বিশেষ রূপটি ধরা পড়েছে। চন্ডীদাসের রাধা অতি দুঃখেও ভেঙে পড়েন না, আবার অতি আনন্দেও দুঃখ ভুলে অপরিমিত মাত্রায় উচ্ছাসিত হয়ে ওঠেন না। সুখের মুহূর্তেও দুঃখের রেশ তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আলোচ্য পদে দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ দীর্ঘদিন পরে মথুরা থেকে ব্রজভূমিতে ফিরে এসেছেন। তাঁকে দর্শন করে শ্রীরাধা অনুদ্বেলিত কণ্ঠে তাঁর দুঃখের অবসান ও সুখের উদয়কথা জানালেন। কৃষ্ণ বহুদিন পরেও যে এসেছেন—এটা রাধার পক্ষে পরম সৌভাগ্যের কথা। তবে বিরহে এতদিন রাধার প্রাণ গেলে তা কৃষ্ণ তাঁকে আর দেখতে পেতেন না। রাধা বিরহের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, যা সহ্য করতে হলে পাষাণও ফেটে যেত। তবু নিজের দুঃখকে তিনি বড়ো বলে মনে করেন না। কৃষ্ণের কুশলেই তাঁর কুশল। যা হোক, কৃষ্ণের আগমনে দীর্ঘ বিচ্ছেদ-যাতনার অবসান হয়েছে। রাধা তাঁর হারানো রত্ন ফিরে পেয়েছেন। এখন কোকিলের গান, ভ্রমরের তান, মলয় পবনের মৃদুমন্দ বহতা, আকাশে চন্দ্রের উদয় আনন্দের পরিবেশকে আরও বিকশিত করে তুলুক। এখন সুখবিলাসে দুঃখের অবসান ঘটল। অতি শান্ত, সংযত সুরে শ্রীরাধা তাঁর বিরহ- যতনার অবসান এবং মিলনের আনন্দের সূচনার উপলব্ধিজাত অনুভূতির পরিচয় দিয়েছেন। শ্রীরাধার উচ্ছ্বাস নয়, গভীর আবেগের সংযত, গভীর অনুভূতির ভাবগম্ভীর প্রকাশই এখানে মুখ্য স্থান অধিকার করেছে।
কবি চণ্ডীদাস সম্পর্কে জানতে এই লেখাগুলো পড়ুন