বঁধু কি আর বলিব তোরে, চণ্ডীদাস, আক্ষেপানুরাগ
বঁধু কি আর বলিব তোরে : আলোচ্য পদটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে।
পাঠকদের সুবিধার্থে পদটির শব্দার্থসহ প্রয়োজনীয় টীকা ও আলোচনা করা হয়েছে।
বঁধু কি আর বলিব তোরে, চণ্ডীদাস, আক্ষেপানুরাগ
মূলপদ
বঁধু, কি আর বলিব তোরে।
অলপ বয়সে পিরীতি করিয়া
রহিতে না দিলি ঘরে।
কামনা করিয়া সাগরে মরিব
সাধিব মনের সাধা।
মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন
তোমারে করিব রাধা।।
পিরীতি করিয়া ছাড়িয়া যাইব
রহিব কদম্বতলে।
ত্রিভঙ্গ হইয়া মুরলী বাজাব
যখন যাইবে জলে।।
মুরলী শুনিয়া মোহিত হইবা
সহজ কুলের বালা।
চণ্ডীদাস কয় তখনি জানিবে
পিরীতি কেমন জ্বালা।।
বঁধু কি আর বলিব তোরে পদটির পূর্বসূত্র
এও এক হিসেবে আক্ষেপানুসারে পদ। রাধার একটি চমৎকার বাসনা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি পরজন্মে কৃষ্ণ হয়ে জন্মাতে চান এবং এটা চান যে, কৃষ্ণ যেন রাধা হয়ে জন্মান। তাহলে এ-জন্মে রাধারূপে তিনি যত যন্ত্রণা পাচ্ছেন, পরজন্মে কৃষ্ণ তা ভোগ করে রাধার প্রেমের জ্বালা অনুভব করতে পারবেন। পদটি জ্ঞানদাসের নামেও প্রচলিত।
বঁধু কি আর বলিব তোরে পদটির শব্দার্থ ও টীকা
অলপ-অল্প। পিরীতি করিয়া-প্রেম করে। রহিতে-থাকতে। কামনা-ইচ্ছা। মনের সাধা-মনের সাধ বা ইচ্ছা। শ্রীনন্দের নন্দন-নন্দরাজার পুত্র। তোমারে করিব রাধা-শ্রীমতী রাধা কৃষ্ণকে বলছেন, পরের জন্মে তিনি যেন রাধা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়িয়া যাইব-তারপর তিনি নিজে কৃষ্ণ হয়ে রাধার সঙ্গে প্রেম করে তারপর তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। মুরলী-বাঁশী। ত্রিভঙ্গ-বংশী বাদনরত শ্রীকৃষ্ণের মোহন রূপ। মোহিত হইবা-মুগ্ধ হবে। বালা-কন্যা। পিরীতি কেমন জ্বালা-প্রেমের কি যন্ত্রণা।
বঁধু কি আর বলিব তোরে পদটির আলোচনা, ব্যাখ্যা, কাব্যসৌন্দর্য
চন্ডীদাসের লেখা আক্ষেপানুরাগের এই পদটিতে শ্রীমতী রাধা তাঁর হৃদয়-যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, বন্ধু তোমাকে আর কি বলব? অল্প বয়সেই প্রেম করে আমাকে আর ঘরে থাকতে দিলে না। মনের সাধ পূরণের জন্য আমি এই কামনা করে সাগরে ডুবে মরবো যেন পরের জন্মে আমি কৃষ্ণ হয়ে জন্মাই, আর তুমি হবে রাধা। তারপর তোমার সঙ্গে প্রেম করে তোমাকে ছেড়ে গিয়ে কদম্বগাছের তলায় গিয়ে ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে বাঁশী বাজাব, আর তুমি তখন রাধা হয়ে যমুনায় জল আনতে যাবে। আর সেই বাঁশী শুনে মুগ্ধ হয়ে তখন তুমি বুঝবে প্রেমের জ্বালা কেমন।
চন্ডীদাসের এই আক্ষেপানুরাগের পদটিতে কিশোরী রাধার মর্ম-যন্ত্রণার সুগভীর প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। নিজের সমাজ-সংসার আত্মীয়-পরিজন নিয়ে তিনি তো ভালোই ছিলেন একসময়। কিন্তু কিশোরী বয়সেই কৃষ্ণ তাঁকে এমনভাবে প্রেমে পাগল করে তুললেন যে তিনি আর ঘরে থাকতেই পারলেন না। আর ঘর ছেড়েও তিনি যে কৃষ্ণকে পেলেন তা-ও নয়, বরং কৃষ্ণের উপেক্ষায় অনাদরে তিনি জ্বলে পুড়ে খাক্ হয়ে গেলেন। আজ তিনি তার প্রতিশোধ নিতে চান। কিন্তু কিভাবে প্রতিশোধ নেবেন? তিনি সমুদ্রের জলে ডুবে মরবেন। কিন্তু মরার জন্যই শুধু মরা নয়, সেই মৃত্যুর পিছনে থাকবে এক বিশেষ মনস্কামনা। তাঁর সেই বিশেষ কামনাটি হল, মৃত্যুর পরজন্মে তিনি যেন কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণ যেন রাধা হয়ে জন্মান। তারপরই আসবে তাঁর প্রতিশোধ নেবার পালা। কেমন হবে সেই প্রতিশোধ? মরমীয়া কবি চন্ডীদাস অনেক বেশি আবেগ নিয়ে শ্রীমতী রাধার সেই প্রতিশোধের ভঙ্গীটি প্রকাশ করেছেন।
এ-জন্মে যেমন অল্প বয়সেই কিশোরী রাধার সঙ্গে প্রেম করে শ্রীকৃয় তাঁকে ঘর থেকে পথে নামিয়ে তারপর তাকে ফেলে চলে গেছেন তেমনি তিনিও পরজন্মে কৃয় হয়ে রাধার সঙ্গে (কৃষ্ণ রাধা হয়ে জন্মাবেন) প্রেম করে তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন কদমগাছের তলায়। তারপর যখন রাধা যমুনায় জল আনতে যাবেন তখন তিনিও এ জন্মের কৃষ্ণের মতো বঙ্কিম ঠামে দাঁড়িয়ে মোহন সুরে বাঁশী বাজাবেন। তাঁর সেই বাঁশী শুনে শ্রীমতী রাধা মুগ্ধ হয়ে যাবেন, আনমনা হয়ে পড়বেন। কৃষ্ণকে পাবার জন্যে যখন তাঁর মনে ব্যাকুলতা জাগবে, হৃদয় উথাল-পাথাল হয়ে পড়বে তখন তিনি (কৃষ্ণ) বুঝতে পারবেন প্রেমের যন্ত্রণা কত ভীষণ, তার জ্বালা কত তীব্র।
কবি চণ্ডীদাস সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা