বঁধু কি আর বলিব আমি, চণ্ডীদাস, নিবেদন
বঁধু কি আর বলিব আমি : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
বঁধু কি আর বলিব আমি, চণ্ডীদাস, নিবেদন
মূলপদ
বঁধু কি আর বলিব আমি।
জীবনে মরণে জনমে জনমে
প্রাণনাথ হৈও তুমি।।
তোমার চরণে আমার পরাণে
বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি।
সব সমর্পিয়া একমন হৈয়া
নিশ্চয় হইলাম দাসী॥
ভাবিয়াছিলাম এ তিন ভুবনে
আর মোর কেহ আছে।
রাধা বলি কেহ সুধাইতে নাই।
দাঁড়াব কাহার কাছে।।
একুলে ওকূলে দুকুলে গোকুলে
আপনা বলিব কায়।
শীতল বলিয়া শরণ লইনু
ও দুটি কমল-পায়।।
না ঠেলহ ছলে অবলা অখলে
যে হয় উচিত তোর।
ভাবিয়া দেখিনু প্রাণনাথ বিনে
গতি যে নাহিক মোর।।
আঁখির নিমিখে যদি নাহি দেখি
তবে সে পরাণে মরি।
চন্ডীদাস কহে পরশ-রতন
গলায় গাঁথিয়া পরি ।।
পূর্বসূত্র
চন্ডীদাসের এই পদে নিবেদনের স্তর অনেক বেশি স্পষ্ট।
বঁধু কি আর বলিব আমি পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
- বঁধু আর … আমি : হে বন্ধু! তোমায় আর কি বলব। তোমার কাছে আমার তো আর কোনো কামনা নেই। বলবার যা বলেছি, তা আবার বলছি।
- জীবনে মরণে … হৈও তুমি : হে কৃষ্ণ। তুমি সর্ব অবস্থায়, সর্ব সময়ে আমার হৃদয়েশ্বর হও—এটুকুই আমার আকাঙ্ক্ষা। লক্ষ করবার কথা চণ্ডীদাসের শব্দচয়ন রাধার নিবেদনের মধ্যেও কৃষ্ণের সক্রিয়তা ব্যঞ্জিত করেছে। রাধা বলতে চাইছেন, আমার তরফ থেকে যেমন আমার হৃদয় কোনো মুহূর্তেও তোমার চিন্তা ছাড়া না হোক, এ আমার প্রার্থনা, ঠিক তেমনি, তোমার তরফ থেকেও এই চাই যে, তুমি আমার হৃদয়ে রাজ্য সর্বদা অধিকার করে থাক।
- তোমার চরণে … বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি : ফাঁসি তো মৃত্যুতুল্য। হ্যাঁ, রাধার মৃত্যুই হয়েছে। কোন রাধার? যে রাধা ভোগ-ঐশ্বর্য স্বামী-গৃহ নিয়ে মত্ত ছিল। হে কৃষ্ণ, তুমি তোমার চরণাশ্রয়রূপ রজ্জু রাধার প্রাণে জড়িয়ে দিয়েছ। তাতে সংসারাসক্ত রাধার মৃত্যু হয়েছে। আবার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিলে গৃহপালিত জীব জীবন, ওই পরিধির বাইরে যেতে পারে না, তোমার প্রেম রজ্জুতে বাঁধা (এখানে ফাঁসি অর্থ ফাঁস দিয়ে বাঁধা ধরে) রাধাও ওই প্রেম গন্ডির বাইরে যেতে আসতেও পারেন না।
- সব সমর্পিয়া … হইলাম দাসী : শ্রীরাধা তার সর্বস্ব সমর্পণের নিবেদন জানাচ্ছেন। সর্বস্ব বলতে শুধু দেহ মন নয়—আর আত্মগর্ব, লোকলজ্জা, সংস্কার ইত্যাদিও। ‘দাসী’ কথাটার মধ্যে নিবেদনের চরম অভিব্যক্তি। আসলে, নিবেদনের মধ্যে দাস্য-প্রেমই প্রধান নয়।
- ভাবিয়াছিলাম … কাহার কাছে : ভেবেছিলাম গৃহত্যাগী, সংসার বিবাগী হয়ে এ তিন ভুবনে আমার আর কেউ থাকল না। ইতিঃপূর্বে যারা ছিল আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন-পরিজন সবই আমি ত্যাগ করেছি। রাধা বলে সস্নেহে বা সম্প্রীতিতে ডাকবার বা কারো কাছে গিয়ে দাঁড়াবার কেউ আছে বলে ভাবিনি। আসলে সর্বস্ব ত্যাগ করেই তো কৃষ্ণের কাছে যেতে হয়। ভক্ত প্রথমে ভাবেন বটে যে সর্বস্ব ত্যাগ করতে হ’ল, আসলে দেখা যায়, ভগবানকে আশ্রয় করেই সে সর্বস্ব পেয়েছে। পরের পংক্তিগুলিতে একথা বলা হয়েছে।
- একুল ওকুলে … কমল-পায় : ‘একুল ওকুল’ বলতে রাধা পিতৃ ও শ্বশুরকুলকে বুঝিয়েছেন। দু’কুলেও তাঁর আপন বলতে কেউ রইল না, গোকুলেও কেউ রইল না। সমস্ত জ্বালা জুড়াতে তিনি শীতল বলে অর্থাৎ পরম আশ্রয় বলে কৃষ্ণের পদযুগ গ্রহণ করেছেন।
- না ঠেলহ … নাহিক মোর : কোনো ছল করে আমাকে ঠেলে দিও না। একে আমি অবলা নারী, আমি খলও নই। অতএব আমাকে ছেড়ে যাওয়া তোমার উচিত হবে না। রাধা বলেছেন, আমি অনেক বিবেচনা করেছি। দেখলাম, তুমি ছাড়া আর আমার গতি নেই। বৈষ্ণব পদাবলীর তাত্ত্বিকতার এটিই শেষ কথা।
- আঁখির নিমিখে … গাঁথিয়া পরি : কৃষ্ণপ্রেম গভীর হলে তাকে এক মুহূর্তও না দেখে থাকা যায় না। তিলেক বিরহও মৃত্যুতুল্য মনে হয়। চণ্ডীদাস বললেন, কৃষ্ণপ্রেম পরশ রতনের মতো সব তুচ্ছতাকে মূল্যবান স্বর্গে পরিণত করে। এ প্রেম তো হেলা করবার নয়—এ তো গলায় গেঁথে ধারণ করবার।
বঁধু কি আর বলিব আমি পদটির সামগ্রিক অর্থ
হে বন্ধু! কি আর বলব আমি! আমার ইহ জীবনের শুরু থেকে পর্যন্ত এবং জন্মান্তরেও তুমি আমার প্রাণনাথ হও। তোমার ওই পায়ে আমি প্রেম রজ্জুতে ফাঁসি গেছি। আমি একাগ্র মনে সর্বস্ব ত্যাগ করে তোমার দাসী হলাম। ভেবেছিলাম এ ত্রিভুবনে আর আমাকে রাধা বলে ডাকবার আর কেউ রইল না—আমি কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব। একুল-ওকুল দু’কুলে বা গোকুলে কাকে আর আপন বলব! শীতল বলে তোমার চরণ কমলে আশ্রয় নিলাম। আমি অবলা নারী এবং ছলনাশূন্য। আমাকে চরণ বঞ্চিত করা তোমার উচিত হবে না। অনেক ভেবে দেখেছি তুমি, হে হৃদয়েশ্বর, তুমি ছাড়া আর আমার গতি নেই। এক পলকও যদি তোমাকে না দেখি, তবে আমি প্রাণে মারা যাই। চন্ডীদাস বলছেন, পরশমণি কি আর কোথাও রাখা যায়; তা গেঁথে গলায় পরতে হয়।
বঁধু কি আর বলিব আমি পদটির তাৎপর্য
সবস্ব ত্যাগ করে প্রেমিক বা সাধক কৃষ্ণে আত্মসমর্পণ করছেন। ত্যাগের আগে ভেবেছিলাম তিনি না জানি কত হারাবেন। কিন্তু এখন বুঝছেন, ত্রিভুবনে এই একমাত্র পথ। এবার ভক্তের কামনা, আমার পক্ষে যতদূর এগোবার তা আমি এগিয়ে এসেছি। হে নাথ, এবার তুমি আমাকে গ্রহণ করো-ত্যাগ করো না। গৌরী! এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেন তোমার? সেই মরকত দেহ কি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারেন? তিনি তোমার সর্বদাই সম্মিলিত আছেন। তোমার বোধের অভাবেই তুমি বিরহ বোধ করো।
“পদাবলির কবি চণ্ডীদাস” সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটি পড়া যেতে পারে