তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম, বিদ্যাপতি, নিবেদন
তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম, বিদ্যাপতি, নিবেদন
মূলপদ
তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম
সুত-মিত-রমণী সমাজে।
তোহে বিসরি’ মন তাহে সমর্পিলুঁ
অব মঝু হব কোনো কাজে।।
মাধব, হাম পরিণাম নিরাশা।
তুহুঁ জগ-তারণ দীন-দয়াময়,
অতয়ে তোহারি বিশোয়াসা।
আধ জনম হাম নিন্দে গোঙায়লুঁ
জরা শিশু কতদিন গেলা।
নিধুবনে রমণী রসরঙ্গে মাতলুঁ
তোহে ভজব কোন বেলা।।
কত চতুরানন, মরি মরি যাওত
ন তুয়া আদি অবসানা।
তোহে জনমি’ পুন, তোহে সমাওত,
সাগর-লহরী সমানা॥
ভণয়ে বিদ্যাপতি শেষ শমন-ভয়
তুয়া বিনু গতি নাহি আরা।
আদি অনাদিক- নাথ কহায়সি,
অবতারণ-ভার তোহারা।।
পূর্বসূত্র
পদটি নিবেদন পর্যায়ের। এই পদে আত্ম অনুশোচনার বিশেষ সুরটি লক্ষ করবার মতো। কবি বা ভক্ত যেন জীবন প্রান্তে এসে এতদিনের অপচয়ের খতিয়ান তৈরি করতে বসেছেন। দেখছেন, সারা জীবনই হয়েছে অপচয়। মোহগ্রস্ত দিন কাটিয়েছেন কবি। কিন্তু অস্তে এসে কবির আন্তরিক বিশ্বাসটি পরিস্ফুট। এই বিশ্বাসই ভক্তের শ্রেষ্ঠ।
তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
তাতল সৈকতে : তপ্ত বেলাভূমিতে।
বারিবিন্দু সম : জলের ফোঁটার মতো।
সূত-মিত-রমণী সমাজে : পুত্র-মিত্র রমনীদের দলের মধ্যে।
তাতল … রমণী সমাজে : তপ্ত বালুবেলায় একফোঁটা জল পড়লে তা যেমন সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যায়, আমিও তেমনি পুত্র-কন্যা-বন্ধু ও প্রিয়া পরিবেষ্টিতে সমাজে নিঃশেষিত হয়েছি।
তোহে বিসরি … কোনো কাজে : হে কৃষ্ণ, হে সর্বৈশ্বর্যময়, প্রীতি ও কাম মোহে আমার মন তোমাকেই বিস্মৃত হয়েছিল। আমি ভ্রমবশে তোমাকে বিস্মৃতি হয়ে প্রীতি ও কামবশে সুতমিত-রমণী মন্ডলে মন সমপর্ণ করেছিলাম। এর দ্বারাই আমি নিঃশেষিত হয়েছি। এখন তাহলে আমি কোনো কাজে লাগব।
মাধব, হাম … নিরাশা : হে মাধব। আমার পরিণাম নৈরাশ্যজনক বলেই মনে হচ্ছে। তোমাকে যে বিস্মৃত হয়, তার প্রতি নিশ্চয় তুমি সদয় হবে না, অতএব তার ভবসিন্ধু অতিক্রমের কোনো আশা নেই।
তুহুঁ জগ তারণ … বিশোয়াসা : আমার যখন এই অবস্থা, আমার কৃতিত্বে যখন নৈরাশ্যই অর্জিত, তখন, হে দীনবন্ধু! হে জগত-তারণ তোমার প্রতিই আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। লক্ষ করবার কথা এই যে—কবি বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে দুটি উপাধিসূচক শব্দে সূচিত করেছেন। একদিকে দয়াময়, দুই জগত-তারণ। কেন? এর মধ্যে ভক্তমনের প্রবণতা ফুটে উঠেছে। ভক্ত নিজেকে দীন ভেবেছেন। আর ঈশ্বর তো দীনের প্রতি দয়াময় এবং তিনি জগতের সকল বস্তুকেই তারণ করেন। অতএব কৃষ্ণের প্রতি বিশ্বাস রাখা যায় যে তিনি দয়া করে তারণ করবেন।
আধ জনম … কতদিন গেলা : এবার নিজের কৃতকর্মের হিসাব করছেন ভক্ত। তাঁর মনে হচ্ছে গোটা জীবনটাই অপচয় হয়েছে। অর্ধেক জীবন তো ঘুমেই কাটিয়ে দিলাম। এখন বার্ধক্য এবং প্রথমে ছিল শৈশব। এসব সময় তো কৃষ্ণপ্রেম অর্জন ব্যয় করা যায় না। এসবের বাইরে সামান্য সময়ই থাকে কৃষ্ণপ্রেম অর্জনে ব্যাপৃত হবার। সে সময়টার কি সুষ্ঠু ব্যবহার করেছি।
নিধুবনে … কোন বেলা : নিধুবনে অর্থ হল, রতিরঙ্গে ওঠায়। কবি বলছেন শৈশব জরা ও নিদ্রায় ব্যয়িত সময় বাদ দিয়ে যেটুকু থাকল, তা ব্যয় করেছি নারীর সঙ্গে রতিলীলায়। এমনি করে জৈবিক ক্রিয়া চর্চাতেই কেটে গেছে জীবন। কোন সময়ে তোমার ভজনা করব।
কত চতুরান … লহরী সমানা : মানুষ তো ক্ষণজীবী। তার তুলনায় ব্রহ্ম দীর্ঘজীবী। একজন মানুষের পক্ষে কয়েক সহস্র যুগ ব্রহ্মার পক্ষে এক লহমা। এমন দীর্ঘজীবী কত ব্রহ্মা মারা যাচ্ছেন, কিন্তু তুমি দেব চির অমর রয়েছ। তোমার আদিও নেই, অনন্তও নেই। এই মানুষ কীট পতঙ্গ থেকে ব্রহ্মা পর্যন্ত সকলেই তোমাতে জন্মে পুণঃ তোমাতেই মৃত্যুবরণ করছে। সাগরের ঢেউ যেমন সমুদ্র থেকে উঠে সমুদ্রে মিলিয়ে যায় ঠিক তেমনি সর্বপ্রকার জীব এমন কী প্রজাপতি ব্রহ্মা ও তোমা থেকে উদ্ভুত হয়ে, তোমাতে বিলীন হন।
ভণয়ে বিদ্যাপতি … ভার তোহারা : শেষ শমন ভয়ে কাতর বিদ্যাপতি বুঝতে পেরেছেন, জীবন যেভাবেই কাটাই না কেন, শেষ আশ্রয় তুমি। তুমি ভিন্ন আর গতি নেই। তোমাকে আদি অনাদিকে প্রভু বলা হয় অতএব আমি নির্দ্বিধায় তোমাতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। পৃথিবীর সবকিছু তারণ করবার ভার তোমার ওপর।
তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম পদটির সামগ্রিক অর্থ
হে মাধব! পুত্র-মিত্র রমণী মণ্ডলের মধ্যে আমি তপ্ত বালুকাবেলায় বিন্দুমাত্র বারির মতো। তোমাকে বিস্মৃত হয়ে ওই সব সঙ্গে কালাতিপাত করেছি। আজ আমি কোন্ কাজে লাগব। আমার পরিণাম নৈরাশ্যজনক। তুমি দীনের প্রতি দয়াশীল, তুমি জগত-তারণ, অতঅব তোমাকে বিশ্বাসই একমাত্র ভরসা।
জীবনের অর্ধেক কাটালাম ঘুমে। জরায় ও শৈশব গেল কত কাল। অবশিষ্ট সময় নারীর সঙ্গে রতিরঙ্গে মাতলাম। তোমাকে ভজনা করব কখন। কত ব্রহ্মা মরে যাচ্ছেন, তোমার আদিও নেই, অন্তও নেই। তোমা হতে জন্মে আবার তোমাতেই সকলে লয়প্রাপ্ত হয় যেমন হয়ে থাকে সমুদ্রের ঢেউ। বিদ্যাপতি শেষ শমনভয়ে অতিশয় কাতর হয়ে বলেছেন, তোমাকে ছাড়া আমার আর গতি নেই। তোমাকে আদি অনাদিক নাথ বলা হয়—অতএব ভবতারণ ভার তোমার ওপরই রাখলাম।
তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম পদটির তাৎপর্য
পদটিতে অভক্ত কেমন করে জীবনকে অকাজে ব্যয় করে সেই বর্ণনা বিশদ। আকুলতাও গভীর। তদ্গত বিশ্বাস কবিতাটিতে এক আশ্চর্য নির্ভরতা সৃষ্টি করেছে।
কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে এই লেখাগুলো পড়া যেতে পারে