চম্পক শোন-কুসুম কনকাচল, গোবিন্দদাস, গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ
চম্পক শোন-কুসুম কনকাচল : এই গৌরাঙ্গবিষয়ক পদটির শব্দার্থ, টীকাসহ আলোচনা এখানে বিধৃত হলো।
পদটির বিস্তারিত আলোচনা এখানে উল্লিখিত হলো। তাছাড়া বৈষ্ণব পদটির কাব্যসৌন্দর্য আলোচিত হয়েছে।
চম্পক শোন-কুসুম কনকাচল, গোবিন্দদাস, গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ
মূলপদ
চম্পক শোন- কুসুম কনকাচল
জিতল গৌর-তনু-লাবণি রে।
উন্নত গীম সীম নাহি অনুভব
জগ-মনোমোহন ভাঙনি রে।।
জয় শচীনন্দন রে।
ত্রিভুবন-মণ্ডন কলিযুগ-কাল-
ভুজগ-ভয়-খণ্ডন রে।।
বিপুল পুলককুল- আকুল কলেবর
গরগর অন্তর প্রেম-ভরে।
লহু লহু হাসনি গদগদ ভাষণি
কত মন্দাকিনী নয়নে ঝরে।।
নিজ-রসে নাচত নয়ন ঢুলায়ত
গাওত কত কত ভকতহি মেলি।
যো রসে ভাসি অবশ মহিমণ্ডল
গোবিন্দদাস তহিঁ পরশ না ভেলি।।
পূর্বসূত্র
এই পদটির শেষার্ধ গৌরচন্দ্রিকা। প্রথমাংশে অবিমিশ্রভাবে তা নেই। তা হয়ে আছে একটি গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ। কবি তাঁর কল্পনাতে অপরূপ সুন্দর দৃষ্টিনন্দন প্রভু চৈতন্যদেবের জীবন্ত বিগ্রহ বর্ণনা করেছেন।
চম্পক শোন-কুসুম কনকাচল পদটির শব্দার্থ, টীকা
- চম্পক, শোনকুসুম : চাঁপা আর শোনফুল।
- কনকাচল : সোনার পাহাড়, কিংবদন্তীর সুবর্ণগিরি।
- জিতল : জিতে নিয়েছে। গৌরাঙ্গের দেহের লাবণ্য চাঁপা, শোনফুল আর সুবর্ণ গিরিকে পরাভূত করেছে। ব্যতিরেকে অলংকারের উদাহরণ এটি।
- উন্নত গীম : সমুন্নত গ্রীবা।
- সীম নাহি অনুভব : সেই সৌন্দর্যের সীমা অনুভব করা যায় না, অর্থাৎ তা ধারণার বাইরে।
- ভাঙনি : ভঙ্গিমা। চৈতন্যের দেহভঙ্গি যা জগতের মনোমোহনকারী।
- ত্রিভুবন-মণ্ডন : ত্রিলোকের অলংকার, শোভা। অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে পরিব্যাপ্ত।
- কলিযুগ-কালভুজগ : কলিকালরূপ কাল সর্প। কলিকাল পাপে ভরা, সেই পাপের ভয় তিনি খণ্ডন বা দূর করেন, মানুষকে তা থেকে মুক্ত করেন।
- বিপুল … প্রেম-ভরে : রোমাঞ্চ (পুলক) প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবে তাঁর শরীর প্রবলভাবে আলোড়িত হচ্ছে, তাঁর হৃদয় প্রেমে পূর্ণ, গদগদ।
- লহু লহু হাসনি : মৃদুমন্দ হাসি।
- লহু : লঘু।
- গদগদ ভাষণি : আবেগাপ্লুত বাণী, কথা।
- কত … ঝরে : চোখে অবিরাম স্বর্গগঙ্গার মতো জল ঝরছে।
- নিজ রসে নাচত : অন্তর্গত (কৃষ্ণ)-প্রেমের আনন্দে তিনি নাচছেন, তাঁর চোখদুটি আবিষ্ট হয়ে আছে। ভক্তদের সঙ্গে কীর্তন করছেন তিনি।
(চৈতন্য-প্রবর্তিত) যে (নতুন রকম) কৃষ্ণ-রসে, বা চৈতন্যের প্রেমরসে সমস্ত জগৎ আবেগ বিহ্বল, কবি গোবিন্দদাস তার স্পর্শ পেলেন না।
চম্পক শোন-কুসুম কনকাচল পদটির ব্যাখ্যা, আলোচনা, কাব্যসৌন্দর্য
পদটি শ্রীমতী রাধার পূর্বরাগ পর্যায়ের গৌরচন্দ্রিকা স্বরূপ। পদটিতে শ্রীগৌরাঙ্গের দিব্যকান্তি ও তাঁর ভাবোন্মত্ত অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। গৌরাঙ্গের দেহ লাবণ্য বা অঙ্গশোভা চম্পক, শোনফুল ও স্বর্ণ-পর্বতকেও জয় করেছে। তাঁর উন্নত গ্রীবা, জগৎমনোমোহন ভঙ্গীর সৌন্দর্য-সীমা যেন অনুভবেও আসে না। শচীনন্দনের জয় হোক। তিনি ত্রিভুবন উজ্জ্বল করেন, কলিযুগ-রূপ কালসর্পের ভয় খণ্ডন করেন। সীমাহীন আনন্দে তাঁর দেহ রোমাঞ্চিত, অন্তর প্রেমে পরিপূর্ণ। তাঁর মৃদুমৃদু হাসি পুলকিত ভাষণ আর দুটি চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু যেন মন্দাকিনীর ধারা। নিজ প্রেমরসে মত্ত হয়ে তিনি নাচছেন, ভাবের আবেগে ঢুলু ঢুলু তাঁর চোখ, শত শত ভক্তের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছেন। তাঁর যে রসে, যে প্রেমবন্যায় সমস্ত জগৎ ভেসে গেল গোবিন্দদাস সেই প্রেমবন্যায় নিমগ্ন হওয়া দূরে থাক, তাঁর স্পর্শ পর্যন্ত পেলেন না।
ব্রজবুলি ভাষায় লেখা গৌরাঙ্গ-বিষয়ক এই পদটি গৌরচন্দ্রিকার অন্তর্ভুক্ত। শ্রীচৈতন্যদেবের ভাবোন্মত্ত অবস্থার কথা পদটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর অসামান্য সৌন্দর্য, দিব্যপ্রেম ও ভাবোন্মত্ততার কথা বলতে গিয়ে কবির যেন তৃপ্তিই হচ্ছে না। দ্বাপর যুগের স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণই আবার কলিযুগরূপ কালসর্পের হাত থেকে জগৎকে রক্ষা করবার জন্য পৃথিবীতে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন। জগৎমোহন, ধারণাতীত সৌন্দর্যময়, কলিযুগরূপ কালসর্পের ভয়খণ্ডনকারী গৌরাঙ্গদেব ভাব বিহ্বল, দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা। তাঁর মৃদু হাসি, গদগদ ভাষণ, নয়নে অশ্রুবারি। তিনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য। নিজের মনেই নাচছেন, ভক্তদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান করছেন আর সমস্ত জগৎ যেন প্রেমবন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ভক্তকবি গোবিন্দদাস তাঁর দেখা পাননি, স্পর্শ পাননি—পদটির শেষে তাঁর সেই বেদনাময় অভিব্যক্তি পাঠকের মনকেও ব্যাকুল করে তোলে।
কবি গোবিন্দদাস সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা