গগনে অব ঘন মেহ দারুণ, রায়শেখর, অভিসার
গগনে অব ঘন মেহ দারুণ : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
গগনে অব ঘন মেহ দারুণ, রায়শেখর, অভিসার
মূলপদ
গগনে অব ঘন মেহ দারুণ
সঘনে দামিনী চমকই।
কুলিশ-পাতন শব্দ ঝন ঝন
পবন খরতর বলগই ।।
সজনি, আজু দুরদিন ভেল।
হামারি কান্ত নিতান্ত আগুসরি
সঙ্কেত-কুঞ্জুহি গেল।॥
তরল জলধর বরিখে ঝর ঝর
গরজে ঘন ঘন ঘোর।
শ্যাম নাগর একলি কৈছনে
পন্থ হেরই মোর।
সঙরি মঝু তনু অবশ ভেল জনু
অথির থর থর কাঁপ।
এ মঝু গুরুজন- নয়ন দারুণ
ঘোর তিমিরহি ঝাপ॥
তুরিতে চল অব কিয়ে বিচারহ
জীবন মঝু আগুসার।
রায় শেখর- বচনে অভিসর
কিয়ে সে বিঘিনি বিথার॥
পূর্বসূত্র
রায়শেখরের এই পদটিও একটি বর্ষা ও তিমিরাভিসারের পদ। এই পদটিতে রায়শেখর রাধার জবানীতে নিদারুণ বর্ষা রাত্রির অভিসারের দুর্গমতাকে চিত্রণের সঙ্গে আর একটা নতুন কথা বলেছেন। শ্রীরাধা একা অভিসার করছেন না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আগেই এই দুর্যোগে সংকেত স্থানে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি এত কষ্ট সহ্য করছেন ভেবে রাধা এত বিচলিত যে নিজের কথা তাঁর মনেই হয়নি।
শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
- অব : এখন।
- মেহ : মেঘ।
- গগনে অব ঘন … চমকই : এখন আকাশে দারুণ ঘন মেঘ, মেঘের সঙ্গে (মেঘ গজর্নের সঙ্গে) বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
- কুলিশ পাতন … খরতর বলগই : বজ্রপাতের ঝন ঝন শব্দ, প্রবল বাতাস আস্ফালন করছে, (শোঁ শোঁ শব্দে বইছে; ধাক্কা মারছে)।
- সজনি, আজু দুরদিন ভেল : ওগো বন্ধু! আজ বড়ো দুর্দিন হল দেখেছি। সামাজিক ও সাংসারিক দৃষ্টিতে এটা দুর্দিন। কিন্তু পরের পংক্তি থেকেই বোঝা যাবে, এটা শ্রীরাধার অন্তরের কথা নয়। নেহাৎ বাইরের কথা।
- হামারি কান্ত … কুঞ্জহি গেল : আমার প্রিয়তম নিতান্ত অগ্রসর হয়ে সংকেত-কুঞ্জে গেলেন। শ্রীরাধা এখন আর কৃষ্ণকে অন্য কোনো সংকেতিক ভাষায় বোঝাচ্ছেন না। তিনি পরিষ্কার বলছেন ‘আমার কান্ত’-আমার স্বামী। লৌকিক বিচারে আয়ন তাঁর স্বামী। ইতঃপূর্বে এই গৃহকর্তার তর্জন গর্জন নীরবে শুনেছেন রাধা কিন্তু কৃষ্ণকে স্বামীরূপে স্বীকার করতে পারেননি। এখানে সে সংকোচ আর নেই।। কৃষ্ণ স্বয়ং পূর্বোহ্নে সংকেতকুঞ্জে উপস্থিত হয়েছেন। সংকেত স্থান থেকেই সংকেত উঠেছে। তাতেই রাধা কৃষ্ণের পূর্বাহ্নে আগমন বুঝেছেন।
- তরল জলধর … ঘন ঘোর : তরল মেঘে ঝর ঝর ধারা ঝরছে। মেঘ ঘন ঘোর গর্জন করছে। বর্ষার মেঘের প্রাথমিক তীব্রতা কমেছে। এখন অবিরল ধারায় ঝরেই যাবে। মেঘ এখন আগের চেয়ে তরল। এ সময়ে বুক কাঁপান গর্জন নেই, তবে বর্ষার ধারা মতোই অবিরাম গর্জে চলেছে মেঘ।
- শ্যাম নাগর … হেরই মোর : আহা একা আমার নগর শ্যাম কীভাবে আমার আগমন পথের দিকে তাকিয়ে আছেন।
- সঙরি মুঝ তনু … থর থর কাঁপ : স্মরণ করে আমার দেহ যেন অবশ হয়ে গেল, অস্থির হয়ে আমি থর থর কাঁপতে থাকলাম। স্বয়ং কৃষ্ণ এই পরিবেশে রাধার জন্য এত ত্যাগ করেছেন জেনে আনন্দে পুলকে রাধার দেহ অবশ হয়ে এল, তিনি কাঁপতে থাকলেন।
- এ মঝু গুরুজন … তিমিরহি ঝাপ : আমার গুরুজনদের (সতর্ক) দৃষ্টি এখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। অর্থাৎ এখন তাঁরা নিদ্রামগ্ন। আসলে ঈশ্বর ভক্তকে আহ্বান কালে বাহ্যত দুর্যোগ হলেও ভক্তের পক্ষে অনুকূল অবসর সৃষ্টি করে দেন।
- তুরিতে চল অব … মঝু আগুসার : তাড়াতাড়ি চল, এখন কীসের বিচার, আমার জীবন এগিয়ে গেছে।। শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান যদি এসেছে, শুনেছি যতি তার সংকেত, তবে আর বিচারের অবকাশ নেই। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আজ আমার জীবন-পতি। তিনিই যদি অগ্রসর হয়ে সংকেত স্থানে এসেছেন, তবে আর দ্বিধা কীসের? ‘জীবন মঝু আগুসার’—এর অর্থ অন্যভাবেও করা যায়। শ্রীকৃষ্ণের সংকেত শোনামাত্র আমার মনপ্রাণ অগ্রসর হয়ে সংকেত স্থানে তাঁর সন্নিধানে চলে গেছে। আর আমার এই দেহটাই এখানে পড়ে আছে। এই দেহটাকে তাঁর কাছে নিতে তবে তার দ্বিধা কোথায়?
- রায়শেখর … বিঘিন বিথার : রায়শেখর বলছেন, হে রাধা, আমার অনুরোধ রাখ, বেরিয়ে পড় অভিসারে, সামনে ছড়িয়ে থাকা বিঘ্নাদিতে কীসের শঙ্কা!
তাৎপর্য
এই পদটিতে কয়েকটি নতুন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই অভিসার করে শ্রীমতী রাধাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বাইরে দুর্যোগ থাকলেও গুরুজনেরা নিদ্রাগত-বিধি যেন অনুকূল পরিবেশ করে দিয়েছেন। মানস সম্মেলন বুঝি হয়েই গেছে—এখন দেহের অভিসারে কীসের কি বাধা। পদটিতে বাস্তব ছবি ও তত্ত্ব যেন একাত্ম হয়ে গেছে।
বৈষ্ণব কবি রায়শেখর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটি দেখুন