BA MA বাংলাপ্রাক আধুনিক বাংলাবৈষ্ণব পদাবলি

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা, চণ্ডীদাস, অভিসার (রসোদ্‌গার)


এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা: প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।

মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা, চণ্ডীদাস, অভিসার (রসোদ্‌গার)


মূলপদ

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা

কেমনে আইল বাটে।

আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে

দেখিয়া পরাণ ফাটে।।

সই, কি আর বলিব তোরে।

কোন পূণ্যফলে সে হেন বঁধুয়া

আসিয়া মিলল মোরে।।

ঘরে গুরুজন ননদী দারুণ

বিলম্বে বাহির হৈনু।

আহা মরি মরি সঙ্কেত করিয়া

কত না যাতনা দিনু।।

বঁধুর পিরিতি আরতি দেখিয়া

মোর মনে হেন করে।

কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া

আনল ভেজাই ঘরে।।

আপনার সুখ সুখ করি মানে

আমার দুখের দুখী।

চণ্ডীদাস কহে বঁধুর পিরিতি

শুনিতে জগত সুখী।।


এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা পদটির পূর্বসূত্র

এটি চণ্ডীদাসের একটি বিচিত্র পদ। এখানে অভিসারের কথা আছে। কিন্তু এটি আসলে একটি রসোদ্গারের পদ। সখিদের কাছে নিজ আৰ্তি প্রকাশকে রসোদ্গার বলা হয়েছে। এখানে রাধিকার সংকেত শুনে কৃষ্ণ সংকেত স্থানে এলেও শ্রীরাধা সময়মতো যেতে পারেননি বলে আপেক্ষ করছেন।

আরো পড়ুন :  কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল, লুইপাদ, চর্যাপদ 1

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা

  • এ ঘোর রাজনী … আইল বাটে : আজকের রাত্রিতে মেঘের ঘটা। অর্থাৎ দুর্যোগের রাত্রি। বজ্র ও অশনিপাতসহ প্রবল বর্ষণ চলছে। ‘মেঘের ঘটা’ এবং ‘ঘোর রজনীতে’ এ অর্থের ইঙ্গিত। এমন রাত্রিতে কৃষ্ণ কি করে এলেন। কৃষ্ণকে সংকেত করবার সময় তো দুর্যোগের কথা আগে ভাগে চিন্তা করেননি রাধা। তা সম্ভবত নয়। কিন্তু আগে ভাগে চিন্তা করেননি রাধা। তা সম্ভবত নয়। কিন্তু দুর্যোগ মাথায় কৃষ্ণ এসে হাজির হতে রাধার এই চিন্তা দেখা দিয়েছে। 
  • আঙ্গিনার মাঝে … পরাণ ফাটে : উঠোনে দাঁড়িয়ে আমার প্রিয়তম ভিজছেন, তা দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু রাধা যেতে পারছেন না। যাবেন কি করে। ঘরে যে ননদাদি জেগে।
  • সই কি আর … মিলিল মোরে : ওগো সখি, তোমাদের আর কি বলব। আমার কোন পুণ্য ফলেই এমন প্রেমাস্পদ আমার ভাগ্যে এসে জুটেছে। শ্রীরাধা কৃষ্ণপ্রেমে গর্বিত।
  • ঘরে গুরুজন … যাতনা দিনু : ঘরে গুরুজনেরা রয়েছেন, দারুণ ননদীরা রয়েছেন, তাই রাধাকে দেরিতে বের হতে হল। তাদের ঘুম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে শ্রীরাধা বের হতে পেরেছেন। এতক্ষণ কৃষ্ণকে অঙ্গনে দাঁড়িয়ে ভিজতে হয়েছে। আহা সংকেত করে ডেকে এনে তাকে কতই না যন্ত্রণা  দিয়েছেন শ্রীরাধা। শ্রীরাধার এই যাতনাই তার স্মৃতিকে বেদনার্ত করেছে। দয়িতের জন্য কৃষ্ণের এত ত্যাগের পরিচয় পেয়েই রাধা বলেছেন, তাঁর ভাগ্যের ফলেই এমন প্রেমিক মিলেছে। 
  • বঁধুর পিরিতি … আনল ভেজাই ঘরে : শ্রীরাধা তার প্রতি কৃষ্ণের প্রেমের পরিচয় পেয়েছেন। বুঝেছেন তাঁর আর্তি, তাই তাঁর মনে হয়েছে, আর প্রয়োজন নেই সাংসারিক মোহের। আর প্রয়োজন নেই গৃহবাসের। এবার অনায়াসে কৃষ্ণপ্রেমের জন্য কলঙ্কের ডালি মাথায় তুলে নেওয়া যায়। এই মোহময় সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ অনুষঙ্গে ত্যাগ করা যায় গৃহ।
  • আপনার দুঃখ … জগত সুখী : কবি বলছেন, কৃষ্ণপ্রীতির এই কথা শুনে জগত নিশ্চয় সুখী হবে যে, কৃষ্ণ প্রেমবশে নিজের দুঃখকে সুখ বলে মনে করেন (তাই অঙ্গনে ভিজতেও আপত্তি নেই তার, রাধা দেরি করে এলেও বিরক্তি নেই তাঁর)। রাধার দুঃখেই মাত্র তিনি দুঃখী হন।
আরো পড়ুন :  বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাংলা অলংকারের মধ্যে পার্থক্য

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা পদটির সামগ্রিক অর্থ

এ এক দুর্যোগময় রাত্রি। আকাশে ঘনঘটা। (কৃষ্ণ) কেমন করে পথ চিনে এলেন? প্রিয় আমার আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে ভিজছেন। দেখে বেদনায় বুক ফেটে যায়। সই, কি আর বলব তোমাকে, কোনো পুণ্যফল আমার এমন প্রেমাস্পদ মিলেছে, তা কে জানে! ঘরে গুরুজনেরা আছেন, দারুণ ননদিনীরা তাই ঘর থকে বের হতে আমার দেরি হল। আহা! সংকেত করে ডেকে এনে তাঁকে কত না যাতনা দিলাম, তা ভাবলে মরে যাই। কৃষ্ণের প্রেম এবং আত্তি দেখে আমার এইরকম মনে হয় যে, কলঙ্কের ডালি মাথায় নিয়ে এই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেই। প্রিয় আমার, নিজের দুঃখকে সুখ বলে মনে করেন, আমার দুঃখেই দুঃখী হন। চণ্ডীদাস বলছেন, কৃষ্ণের প্রীতির এই রীতি শুনে জগত খুশি হন।

আরো পড়ুন :  তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম, বিদ্যাপতি, নিবেদন

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা পদটির তাৎপর্য

এই পদটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী‘ পত্রিকায় এই পদার্টির খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করে লেখেন—“ভগবান্ আমাদিগকে কখনই ছাড়েন না; পাপের ঘোর অন্ধকারে এখন আমরা পড়িয়া থাকি, তখনও সেই পাপীর দুঃখের ভার নিজ মাথায় লইয়া তিনি তাহার জন্য অপেক্ষা করেন। সংসারাসক্তচিত্ত আমরা সংসারের সহস্র ঝঞ্ঝাট ছাড়িয়া তাঁহার কাছে যাইতে পারি না। তিনি দুর্গম পন্থায় দাঁড়াইয়া আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করিতে থাকেন–পাপীর কাছে আসিতে কণ্টকাকীর্ণ পথে তাঁহার পদতল ক্ষতবিক্ষত হইয়া যায়, তথাপি তিনি আমাদের ত্যাগ করেন না।”


“পদাবলির কবি চণ্ডীদাস” সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটি পড়া যেতে পারে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!