এমন পিরিতি কভু নাহি দেখি শুনি, চণ্ডীদাস, পূর্বরাগ
এমন পিরিতি কভু : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
এমন পিরিতি কভু নাহি দেখি শুনি, চণ্ডীদাস, পূর্বরাগ
মূলপদ
এমন পিরিতি কভু নাহি দেখি শুনি।
পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি॥
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।
জল বিনু মীন যেন কবহুঁ না জীয়ে।
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে॥
ভানু-কমল বলি সেহো হেন নয়।
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রয়।।
চাতক-জলদ কহি সে নহে তুলনা।
সময় নহিলে সে না দেয় এক কণা।
কুসুমে মধুপ কহি সেহো নহে তুল।
না যাইলে ভ্রমর আপনি না দেয় ফুল।।
কি ছার চকোর-চান্দ দুহুঁ সম নহে।
ত্রিভুবনে হেন নাহি চণ্ডীদাসে কহে।।
এমন পিরিতি কভু পদটির পূর্বসূত্র
পদাবলির কবি চণ্ডীদাসের এই পদটিতে কবি নিজেই রাধা-কৃষ্ণের পূর্বরাগের বর্ণনা করছেন। কবি যেন স্বয়ং তাদের প্রেম-লীলার সহচর। তিনি তাদের অনুরাগের গভীরতায় বিমুগ্ধ-চিত্ত। একের পর এক তুলনা দিয়ে তিনি তাদের পারস্পারিক আকর্ষণের স্বরূপ বোঝাতে চেয়েছেন।
এমন পিরিতি কভু পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
- এমন পিরিতি : শ্রীরাধা ও কৃষ্ণের পারস্পরিক প্রীতি।
- পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি : আপনা আপনি তারা প্রাণে প্রাণে আবদ্ধ। তাদের প্রীতির বন্ধন শুধু চোখে বা দেহে নয়—তা নিগূঢ়ভাবে পরাণের সঙ্গে পরাণের—তাই অচ্ছেদ্য।
- দুহুঁ কোরে : দু’জনের কোলে। আলিঙ্গনাবস্থায়।
- দুহুঁ কোরে … বিচ্ছেদ ভাবিয়া : পরস্পর আলিঙ্গন অবস্থাতেও ভাবে বুঝিবা সম্পূর্ণ মিলন হল না। কোথায় যেন ফাঁক থেকে গেল। সেই অনুমাত্র ছেদ তাঁদের হতাশ করে। তাঁরা বিচ্ছেদ ভেবে আকুল হন।
- আধ তিল … যায় সে মরিয়া : মুহূর্তের জন্যও যদি চোখের বাইরে থাকেন, তবে তা মৃত্যুতুল্য বোধ হয়। অর্থাৎ দর্শনানন্দের ছেদ মৃতুতুল্য ভাবে।
- জল বিনু মীন যেন : একে অন্যকে ছাড়া যেন জল ছাড়া মাছের অবস্থা। অর্থাৎ একে অন্যের প্রাণজ প্রতিকূল অবস্থা মাত্র।
- ভানু কমল বলি সেহো যেন নয় : কবি প্রসিদ্ধি এই যে, সূর্য উঠলে পদ্ম বিকশিত হয়, তার আগে পরে মুদিত থাকে। এদের সম্পর্কও যেন ঠিক সেই রকম। একজনের দর্শনে অপরে যেন আনন্দে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। তার আগে পরে ওই আনন্দ থাকে না। এই নিরপেক্ষ অবস্থাকে কমলের মুদিত অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
- হিমে কমল মরে ভানু সুখে রয় : রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্ককে ‘ভানু-কমল’ সম্পর্ক বলেই কবির মনে অন্য কথার উদয় হয়েছে। কবি বলছেন, আমার এ তুলনা ত ঠিক হল না। ভানু-কমলের মতো পরস্পরের দর্শনে পরস্পর আনন্দিত তথা বিকশিত হন বটে, কিন্তু অন্যক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক এমন নয়। শীত এলে পদ্ম মরে যায়। কিন্তু সূর্য দিব্যি থাকে। তার রীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না। কিন্তু এদের সম্পর্ক তেমন নয়। এখানে কবি উপমান থেকে উপমেয়ের উৎকর্ষ প্রমাণ করেছেন। অতএব ব্যতিরেক অলঙ্কার ঘটেছে।
- চাতক জলদ … দেয় এক কণা : এদের সম্পর্ককে কি চাতক-জলদ সম্পর্ক বলা যায়। পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে দর্শন-স্পর্শন-মিলন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পরস্পর অপেক্ষা করেন, তা চাতকের মেঘের প্রতি আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তুলনেয় হলেও, মেঘ চাতকের প্রত্যাশা, পুরণে যে কার্পণ্য করে, চাতককে বিশেষ কালের জন্য (বর্ষার জন্য) যে অপেক্ষা করতে হয়, তাকে এঁদের পারস্পরিক প্রত্যাশা পূরণের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বর্ষা হলে জল দেব এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে কৃষ্ণ বা রাধা অপরকে পীড়িত করেন না।
- কুসুমে মধুপ কহি সেহো নহে … না দেয় ফুল : ভ্রমর-পুষ্পের তুলনা মনে এসেছে কবির। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছেন, এ তুলনাও খাটে না। কারণ ফুল থাকে স্থির। ভ্রমরকেই ছুটে ছুটে আসতে হয়। কিন্তু রাধা বা কৃষ্ণ দু’জনেই দু’জনের জন্য ব্যাকুল। রাধাও যেমন সংকেত স্থানে যান, কৃষ্ণও তেমনি সংকেত স্থানে আসেন।
- কি ছার চকোর-চান্দ … চণ্ডীদাস কহে : চকোর-চাঁদের তুলনাও পুষ্প-ভ্রমরের উদাহরণের তুলনায় ব্যর্থ। চকোর-চাঁদের তুলনাও পুষ্প-ভ্রমরের উদাহরণের তুলনায় ব্যর্থ। চকোরকেই কেঁদে মরতে হয়। চাঁদ উদাস। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটির সঙ্গে তুলনীয় নয়।
এমন পিরিতি কভু পদটির সামগ্রিক অর্থ
এমন প্রগাঢ় প্রেমের কথা কখন দেখিওনি, শুনিওনি। স্বভাববশেই প্রাণে প্রাণ বাঁধা আছে। আলিঙ্গন-অবস্থাতেই উভয়ে বিচ্ছেদ ভেবে আকুল হন। একজন আর একজনকে আধ তিল না দেখলেও মরে যান। জল ছাড়া মাছ যেমন কখনও জীবিত থাকে না। মানব সমাজে এমন প্রেম দেখা যায় না। পদ্ম ও সূর্যেরও এমন নয়। শীত এলে পদ্ম শুকিয়ে মরে যায়, কিন্তু সূর্য আনন্দেই থাকে। চাতক-মেঘের তুলনাও ব্যর্থ, কারণ, সময় না এলে মেঘ এক কণা জলও দেয় না। কুসুম-ভ্রমরও তাদের তুলনেয় নয়। ভ্রমর না গেলে কুসুম কি মধু দেয়। চকোর-চাঁদও তাদের তুলনেয় নয়। চণ্ডীদাস বলেছেন, ত্রিভুবনে এমন আর হয় না।
এমন পিরিতি কভু পদটির তাৎপর্য
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বা ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ক অপার্থিব, তাকে পার্থিব কোনোরকম প্রসিদ্ধ প্রেম সম্পর্ক নিয়েই পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় না। বাহ্যত ভক্তপ্রেম আকুল এবং ভগবানের প্রতি সর্বস্ব ত্যাগে ধাবিত বলে মনে হলেও, ওই আকুলতা ও প্রত্যুদগমন ঈশ্বরের তরফেও রয়েছে।