আমার শপতি লাগে না ধাইও ধেনুর আগে, যাদবেন্দ্র, বাল্যলীলা
আমার শপতি লাগে : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।
আমার শপতি লাগে না ধাইও ধেনুর আগে, যাদবেন্দ্র, বাল্যলীলা
মূলপদ
আমার শপতি লাগে না ধাইও ধেনুর আগে
পরাণের পরাণ নীলমণি।
নিকটে রাখিহ ধেনু পূরহি মোহণ বেণু
ঘরে বসি আমি যেন শুনি।
বলাই ধাইবে আগে আর শিশু বামভাগে
শ্রীদাম সুদাম সব পাছে।
তুমি তার মাঝে ধাইও সঙ্গ ছাড়া না হইও
মাঠে বড়ো রিপুভয় আছে।।
ক্ষুধা পেলে চাঞা খাইও পথ পানে চাহি যাইও
অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে।
কারু বোলে বর ধেনু ফিরাইতে না যাইও কানু
হাত তুলি দেহ মোর মাথে।।
থাকিহ তরুর ছায় মিনতি করিছে মায়
রবি যেন না লাগয়ে গায়।
যাদবেন্দ্রে সঙ্গে লইও বাধা পানই হাতে থুইও
বুঝিয়া যোগাবে রাঙ্গা পায়।।
পূর্বসূত্র
যাদবেন্দ্রের রচিত এ পদটিও একটি বাল্যলীলার পদ। এখানে পুত্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় মায়ের উৎকণ্ঠা ও আকুলতাই প্রকাশিত হয়েছে। পদটি বাৎসল্য রসে ভরপুর। এর মধ্যে ভক্তের আকুতিও লক্ষ করবার মতো। এই কবিতাটিতে নাটকীয় চিত্রময়তা ফুটে উঠেছে। কবি নিজেকে কৃষ্ণ অনুচরদের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন। এখানে শুধু বর্ণনা চাতুর্য নয়—সেই সঙ্গে ভক্ত হৃদয়ের আকুতিও মিশ্রিত হয়েছে।
শব্দার্থ টীকা ও ব্যাখ্যা
** সমগ্র কবিতাটি মা যশোদার উক্তি। কৃষ্ণ ধেনুদল শ্রীদাম যাচ্ছেন গোচরণে। আগে শ্রীদাম সুবল ইত্যাদি অনুচরেরা। মা সঙ্গে খাবারাদিও বেঁধে দিয়েছেন। বিদায় মুহূর্তে মা নানাভাবে সতর্ক করছেন পুত্রকে। শপথ করাচ্ছেন। **
আমার শপতি লাগে : শপতি = শপথ। যশোদা দিব্যি দিচ্ছেন। নিজের দিব্যি। এর অন্যথা করলে যশোদার মৃত্যু হবে। দেখ কৃষ্ণ, তোমার আচার আচরণের ওপরেই আমার বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া নির্ভর করছে।
না ধাইও ধেনুর আগে : গরুগুলির আগে ছুটবে না। গরুগুলি হঠাৎ দ্রুত ছুটে তোমাকে ফেলে দিতে পারে, মাড়িয়ে যেতে পারে।
পরাণের পরাণ নীলমণি : হে নীলমণি, তুমি আমার পরাণেরও প্রাণ। অর্থাৎ তুমি আমার পরাণের সারাৎসার।
পুরিহ মোহন বেণু : কৃষ্ণ বাঁশির রবে বিশ্ব পূরিত করেন, মোহিত করেন। সেইজন্য তাঁর বাঁশিকে বলা হয় মোহন বেণু। মা যশোদা কৃষ্ণের ওই ঐশ্বর্যরূপে বা জীবাত্ম স্বরূপ বোঝেন না। তিনি পুত্রোপম কৃষ্ণকে ওই মোহন বেণু পুরিত করতে অর্থাৎ বাজাতে বলছেন। তিনি ঘরে বসে ওই শব্দ শুনে বুঝবেন যে কৃষ্ণ নিরাপদে আছে।
বলাই ধাইবে আগে … রিপুভয় আছে : ভাগবতে আমরা পাই যে, কৃষ্ণ গোচারণে গেলে বকাসুর, গর্দভাসুর থেকে নানা অসুর তাঁকে আক্রমণ করে। প্রতিবারই কৃষ্ণ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে শুধু নিজেকে নয়, সকলকেই রক্ষা করেন। তবু মায়ের আশঙ্কা প্রবলতর অসুরও তো থাকতে পারে। অতএব তিনি কৃষ্ণকে সকলের মাঝখানে থাকতে বলছেন। ডান দিকে গরুর পাল, বামে অন্য শিশুরা, সামনে বলাই অর্থাৎ বলরাম পিছনে শ্রীদাম ও সুবল। সঙ্গহীন হতেও নিষেধ করছেন। যাদব বংশের ছেলেকে গোচারণে যেতে নিষেধ করতে পারেন না মা, কিন্তু মাঠে নানা রিপু ভয়ের কথাও ভুলতে পারেন না। তাই নানাবিধ সতর্কতা।
ক্ষুধা পেলে চাঞা খাইও … তৃণাঙ্কুর পথে : ছেলের শক্তিতে মায়ের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। না চাইতেই মা বুঝে খেতে দেন। কিন্তু মাঠে কে তাকে সময়মত খেতে দেবে। অতএব ওগো কানাই ক্ষিধে পেলে লজ্জা করে থেকো না। খাবার সঙ্গেই রইল। চেয়ে নিও। আর দেখ, আনমনা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে পথ চলো না। পথ তো গৃহাঙ্গণ নয়—পথে অজস্র তৃণাঙ্কুর। পা কেটে যেতে পারে।
কারু বোলে … না যাইও কানু : ওগো কানাই। কারো কথায় তুমি বড়ো বড়ো গরুগুলি ফিরিয়ে আনতে যেও না। একে তো ও গুলির শক্তি বেশি, ওপরে ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে—ফলে ওরা তোমাকে আক্রমণ করতে পারে।
হাততুলি দেহ মোর সাথে : আমার মাথায় হাত তুলে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করো।
বাধা পানই হাতে থুইও : পানই অর্থ পাদুকা। সম্ভবত উপানৎ শব্দ থেকে উৎপন্ন। ‘বাধা পানই’ অর্থ তোমার মাপের জুতোটি। জুতোজোড়া যেখানে সেখানে রেখো না। হাতেই রেখো।
সামগ্রিক অর্থ
[যশোদা বলছেন] হে আমার প্রাণের পরাণ নীলমণি। আমার দিব্যি রইল, তুমি গরুগুলির আগে আগে ছুটো না। গরুগুলিকে কাছেই রেখে তুমি মোহন বাঁশি বাজাবে যাতে আমি ঘরে বসেই শুনতে পাই। [বুঝি যে তুমি নিরাপদে আছ]। বলাই আগে যাবে, অন্য ছেলেরা যাবে বামে, সামনে থাকবে বলাই আর পিছনে শ্রীদাম-সুবল। তুমি সবার মাঝখানে থাকবে। সঙ্গ ছাড়া হবে না। মাঠে বড়ো শত্রুর ভয়।
কানাই, ক্ষুধা পেলে চেয়ে নিয়ে খেও। পথ দেখে পথ চলবে—পথে বড়ো তৃণাঙ্কুর থাকে। দেখো, কারো কথা শুনে বড়ো গরুগুলি ফেরাতে যেও না। আমার মাথার হাত রেখে শপথ করো। ওগো কানাই মা মিনতি করছে, সবসময় ছায়ায় থাকবে, গায়ে রোদ লাগাবে না। আর যাদবেন্দ্রকে সঙ্গে নিও, বাঁধা পাদুকা তার হাতে রেখো, প্রয়োজন মতো সে যুগিয়ে দেবে।