আজু হাম কি পেখলুঁ নবদ্বীপচন্দ, রাধামোহন ঠাকুর, গৌরচন্দ্রিকা
Last Updated on : June 12, 2024
আজু হাম কি পেখলুঁ নবদ্বীপচন্দ : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল
আজু হাম কি পেখলুঁ নবদ্বীপচন্দ, রাধামোহন ঠাকুর, গৌরচন্দ্রিকা
মূলপদ
রাধামোহন ঠাকুর | গৌরচন্দ্রিকা
আজু হাম কি পেখলুঁ নবদ্বীপচন্দ।
করতলে করই বয়ন অবলম্ব।।
পুন পুন গতাগতি করু ঘর পথ।
খেনে খেনে ফুলবনে চলই একান্ত।।
ছল ছল নয়ন-কমল—সুবিলাস।
নব নব ভাব করত পরকাশ।।
পুলক-মুকুলবর ভরু সব দেহ।
রাধামোহন কছু না পাওল থেহ।।
পূর্বসূত্র
গৌরচন্দ্রিকাকে বলা হয় লীলা প্রবেশক। অর্থাৎ এই ভাবকে অবলম্বন করে সহজেই রাধাকৃষ্ণ প্রেমবিষয়ক ভাবে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। তাই দেখা যাবে এই পদে পদকর্তা রাধামাধব চৈতন্যদেবের যে রূপ বর্ণনা করেছেন, চন্ডীদাসের বহু রাধা বিষয়ক পদে তারই বিকাশ। এই পদটিকে যেন ভাব-ঐক্য নেই। প্রথম দুই পদে ভাববিহ্বল স্থির চৈতন্যের ছবি। তিনি করতলে মাথা রেখে কি ভাবছেন। পরের পদেই অস্থির চৈতন্য বারবার ঘর-পথ করছেন। কবি কিছুতেই থই পাচ্ছেন না।
আলোচ্য পদের শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা
আজু হাম … নবদ্বীপচন্দ্র : আজ আমি চৈতন্যের এ কি রূপ দেখলাম। কবির বিস্ময়।
করতলে … অবলম্ব : হাতের পাতার ওপর মুখমণ্ডল রেখে আছেন। গভীর চিন্তা বা তন্ময়তার ভঙ্গি। এ অবস্থায় মানুষ স্থির হয়ে যায়।
পুণ পুণ গতাগতি করু ঘর পন্থ : বার বার যাতায়াত করছেন। একবার ঘরে যাচ্ছেন, একবার পথে আসছেন। অর্থাৎ চৈতন্যদেবের মনে চঞ্চলতা। কোথাও স্থির হতে পারছেন না তিনি।
খেনে খেনে … একান্ত : ক্ষণে ক্ষণে চলেছেন, যাচ্ছেন একা একাই। ‘একান্ত’ কথাটির অর্থ ‘নির্জন’ও হয়। নির্জন ফুলবনে ক্ষণে ক্ষণে যাচ্ছেন এ অর্থও গ্রহণ করা যায়।
ছল ছল … সুবিলাস : কমলের মতো চোখ। রূপক অলঙ্কার। মনে হয় সৌন্দর্য আরোপের জন্যই নয়ন না বলে নয়ন-কমল বলা হয়েছে। কারণ এখানে কমল বলার বিশেষ তাৎপর্য নেই। বরং ‘ছলছল’ শব্দটি থাকায় জলাশয়ের সঙ্গে মেলালেই ভাল হত। মোট কথা চৈতন্যের বিশাল চোখ দুটি অশ্রুতে টলমল করছে—এটাই বোঝাতে চেয়েছেন কবি।
নব-নব ভাব করত পরকাশ (প্রকাশ > স্বরভক্তি) : নতুন নতুন ভাব প্রকাশ করছেন। কিন্তু কোথায় ভাব প্রকাশ করছেন? চোখে না দেহে? ওপরের চরণের সঙ্গে মেলালে চোখে, নিচের চরণের সঙ্গে মেলালে দেহে।
পুলক-মুকুলবর ভরু সব দেহ : আনন্দে দেহ কণ্টকিত হয়ে ওঠে-খাড়া হয়ে ওঠে লোমগুলি। একেই আনন্দ-মুকুল বলা হয়েছে। সারা দেহ আনন্দমুকুলে ছেয়ে গেল।
রাধামোহন কভু না পাওল থেহ (থৈ) : পদকর্তা রাধামোহন চৈতন্যদেবের এই ভাববিলাসের থৈ পেলেন না। এখানে ‘রাধামোহন’ শব্দটিতে শ্লেষও গ্রহণ করা যায়। রাধামোহন তো স্বয়ং কৃষ্ণ। স্বয়ং কৃষ্ণও চৈতন্যের এই ভাববিলাসের তল পাচ্ছেন না—তা এতই অতল।
আলোচ্য পদটির সামগ্রিক অর্থ
আজ (আমি) নবদ্বীপচন্দ্রের (চৈতন্যদেবের) এ কি রূপ প্রত্যক্ষ করলাম। তিনি করতলে মস্তক অবনত করে আছেন। তিনি বারবার ঘরে এবং পথে যাতায়াত করছেন। ক্ষণে ক্ষণে নির্জন ফুলবনে একাকী যাচ্ছেন। তাঁর সুবিশাল নয়নদুটি অশ্রুতে ছলছল করছে। নতুন নতুন কত ভাবই প্রকাশিত হচ্ছে। আনন্দ-মুকুলে সমগ্র দেহ ভরে গেছে। রাধামাধব তার কোনো থই (তল) পাননি।