BA MA বাংলাপ্রাক আধুনিক বাংলাবৈষ্ণব পদাবলি

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ, বিদ্যাপতি, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)


আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ : প্রিয় শিক্ষার্থীরা, বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।

মূলপদসহ পদের অর্থ, টীকা, ব্যাখ্যা ও সামগ্রিক অর্থ দেওয়া হলো। পদটি কোন পর্যায়ের সেটিও উল্লিখিত হল।

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ, বিদ্যাপতি, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)


মূলপদ

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ

পেখলুঁ পিয়া-মুখ-চন্দা।

জীবন-যৌবন সফল করি মানলুঁ

দশ দিক ভেল নিরদন্দা।।

আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলুঁ

আজু মঝু দেহ ভেদ দেহা।

আজু বিহি মোহে অনুকূল হোয়ল

টুটল সবহুঁ সন্দেহা॥

সোই কোকিল অব লাখ লাখ ভাকউ

লাখ উদয় করু চন্দা।

পাঁচবাণ অব লাখ বাণ হোউ

মলয় পবন বহু মন্দা।।

অব মঝু যব পিয়া সঙ্গ হোয়ত

তবহুঁ মানব নিজ দেহা।

বিদ্যাপতি কহ লপ ভাগি নহ

ধনি ধনি তুয়া নব লেহা।।


পূর্বসূত্র

এই পদটিতে যথার্থ সম্মেলনের বর্ণনা করা হয়েছে। কিংবা বলা যায় শ্রীকৃষ্ণকে কাছে পাবার ভাবোল্লাস এই পদটিতে বর্ণিত।

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ পদটির শব্দার্থ, টীকা ও ব্যাখ্যা

আজু রজনী … মুখ চন্দা

আরো পড়ুন :  ভাব সম্মিলন কবিতা, বিদ্যাপতি, উৎস ব্যাখ্যা শব্দার্থ প্রশ্ন উত্তর

শ্রীরাধা বলছেন, আজকের রাত পোহানো আমার ভাগ্যে সফল হয়েছে। বহু ভাগ্যে এই দিনটির আগমন। কেননা বহু প্রত্যাশিত প্রিয়মুখ দর্শন ঘটেছে আমার জীবনে। আজ তিনি আমার গৃহে এসেছেন। 

জীবন-যৌবন … নির দন্দা : আজকে আমার জীবন যৌবন সফল হল। সকল দিকের সকল দ্বন্দ্ব কেটে গেল। শ্রীরাধার তো একটিই লক্ষ্য ছিল। তা হল কৃষ্ণসঙ্গ পাওয়া। একেই তিনি জীবন ও যৌবনের একমাত্র সাফল্যের কারণ বলে ভেবেছেন। কৃষ্ণসঙ্গ পাবার আগেই বিরহে তাঁর সব মৃত্যু ঘটবে কিনা, এ ছিল তাঁর সর্বক্ষণের দ্বন্দ্ব। আজ কৃষ্ণ তাঁর গৃহে সমাগত হওয়ায় তাঁর দ্বন্দ্ব মিটে গেছে, সফল মনে হচ্ছে তাঁর জীবন যৌবন। 

অজু মঝু … ভেল দেহা : গৃহে বাস করেও এতদিন শ্রীরাধার মনে হত তিনি নিরাশ্রয়। প্রিয়জন শূন্য গৃহ অরণ্যের সমান। প্রিয় সমাগমে সে-গৃহ আজ পূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। শ্রীরাধার দেহ ও দেহধারণকেও এতদিন নিরর্থক বলে বোধ হত। কিন্তু আজ দেহকেও সাধক বলে বোধ হচ্ছে। দেহ আছে দেখো কৃষ্ণসঙ্গ লাভ সম্ভব হয়েছে। আজই দেহ যথার্থ দেহ হয়েছে। 

আজু বিহি … সবহুঁ সন্দেহা : আজ বিধি আমার অনুকূল হয়েছে। সমস্ত বাধা বিপত্তি ও প্রতিকুলতা আমি অতিক্রম করেছি। সকল রকম দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে। তাত্ত্বিক দিক থেকেও একথা সত্য। কৃষ্ণ প্রাপ্তিতেই তো সব দ্বন্দ্বের অবসান।

আরো পড়ুন :  পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে, বিদ্যাপতি, ভাবোল্লাস (ভাব সম্মিলন)

সোই কোকিল … বহু মন্দা : বিরহের দিনে কোকিলের ডাক শ্রীরাধার যন্ত্রণা বাড়িয়েছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোকিল তাদেরই মিলনের আনন্দে গান গাইছে। মদনের পঞ্চশর বিরহের দিনে ছিল  অবাঞ্ছিত  ক্লেশকর। পঞ্চবাণকে মনে হত অতিরিক্ত। কিন্তু কৃষ্ণপ্রাপ্তিতে যে কামবেগ তাতে মনে হচ্ছে পঞ্চবাণ নয় মদনদেব লক্ষ লক্ষ বাণ ক্ষেপণ করেছেন। আর তা নিরানন্দ নয়-তাঁর মনে আনন্দে ভরপুর করে তুলেছে।

অব মঝু … নিজ দেহা : আজ যখন আমার প্রিয় সঙ্গ লাভ হইল তখন আমার এ দেহকে মানতে বাধা দেখি না, কারণ এ দেহ ছিল বলেই তো এ সম্মেলন হল, অতএব এ দেহ আর বাধা নয়। বিদ্যাপতি সিদ্ধান্ত করছেন, হে দেবী রাধা তোমার মতো ভাগ্যবতী কজন? কৃষ্ণের প্রতি ধন্য তোমার অনুরাগ।

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ পদটির সামগ্রিক অর্থ

কি সৌভাগ্যেই আজকের রজনী প্রভাত হয়েছে-আজ প্রিয়মুখ সন্দর্শন করলাম। আমার জীবন যৌবনকে আজ সফল বলে স্বীকার করলাম। আমার দশ দিক নির্দ্বন্দ্ব হল। আজ আমার গৃহকে গৃহ বলে মনে হচ্ছে, আমার দেহকেও মনে হচ্ছে দেহ বলে। আজ বিধি আমার প্রতি অনুকূল হল, সব সন্দেহ ভঞ্জন হল। সেই কোকিল আজ লক্ষ লক্ষ ডাকছে, হয়েছে লক্ষ চন্দ্রের উদয়। পঞ্চবাণ আজ হয়েছে লক্ষ বাণ-মলয় পবন বইছে আজ। (অর্থাৎ সব ঝড়-ঝঞ্ঝা থেমে গেছে)। আজ যদি প্রিয় সঙ্গ লাভ করলাম তবে নিজের দেহকে মেনে নিলাম। বিদ্যাপতি বলছেন, তুমি, শ্রীমতী অল্প ভাগ্যবতী নও। তোমার এই নব স্নেহ ধন্য।

আরো পড়ুন :  তাতল সৈকত বারি বিন্দুসম, বিদ্যাপতি, নিবেদন

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ পদটির তাৎপর্য

পদটিতে ভক্ত ও শ্রীরাধা একে অন্যের সঙ্গে মিশে আছেন। এতদিন ভক্ত বা রাধার মনে হয়েছে এ দেহই বুঝি বা মিলনে বাধা। আজ তিনি সম্মিলিত হয়ে ভাবছেন, ভাগ্যে দেহ ছিল তাঁর। কৃষ্ণ-সম্মেলনে মনে হচ্ছে পার্থিব বস্তুর আনন্দও বহুগুণিত হয়েছে। প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। আসলে আনন্দ-স্বরূপ কৃষ্ণ সত্তায় ভক্ত বা রাধার দৃষ্টি সম্পৃক্ত। অতএব সকলই আনন্দময় দেখছেন।


কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে এই লেখাগুলো পড়া যেতে পারে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!